বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন একসময় ছিল প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় ঘেরা, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক ছিল গভীর। গ্রামই ছিল আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অর্থনীতির মূলভিত্তি। কিন্তু কালের বিবর্তনে, নগরায়ন ও আধুনিকতার প্রভাবে গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঔতিহ্যগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের জীবন একসময় ছিল সরল, সাদাসিধে ও শান্তিপূর্ণ। সকাল বেলার পাখির ডাক, কৃষকের মাঠে কাজ করা, আর সন্ধ্যাবেলায় গল্পগুজব ছিল গ্রামের নিত্যদিনের চিত্র। গরুর গাড়ি, কাঁচা রাস্তা, পুকুরপাড়ে ছেলেমেয়েদের হৈচৈ আর সন্ধ্যায় কুপি বাতির আলোয় পড়াশোনা ও ঘরের আড্ডা—সবই ছিল গ্রামীণ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্রামের মানুষের মধ্যে ছিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক। একজনের বিপদে পুরো গ্রাম পাশে দাঁড়াতো। বৈঠকখানায় গ্রামের প্রবীণরা সিদ্ধান্ত নিতেন, এবং তা ছিল সর্বজনগ্রাহ্য। উৎসব থেকে শোক—সবকিছুতেই সবাই একত্রিত হতো।
কৃষি ছিল গ্রামের জীবিকার প্রধান মাধ্যম। ধান চাষ, মাছ ধরা, গবাদিপশু পালন ছিল তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এছাড়া তাঁত শিল্প, মাটির জিনিসপত্র তৈরি, এবং গাছের তলায় ছোট দোকান চালানোও ছিল সাধারণ পেশা। নারীরা বাসায় বসে কাঁথা সেলাই, মাটির পুতুল বানানো বা পরিবারের গৃহপালিত পশু-পাখি দেখাশোনা করতেন।
বাংলার গ্রামে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি ও ঔতিহ্যের মিলবন্ধন ছিল। পালাগান ও বাউলগান ছিল গ্রাম্য মেলার প্রাণ। পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল দুই চাকার গরুর গাড়ি। হাডুডু, গোল্লাছুট, কানামাছি খেলার মতো খেলাগুলো ছিল শিশু-কিশোরদের প্রিয়। গ্রীষ্মের শুরুতে পহেলা বৈশাখ, কৃষকদের ঘরে নতুন ধান তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসব ইত্যাদি ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মাটির ঘর, বাঁশের বেড়া আর খড়ের চালা ছিল গ্রামীন ঘর-বাড়ির বৈশিষ্ট্য।
কৃষিকাজের জন্য গরুর লাঙ্গল দিয়ে জমি কর্ষণ করা হতো। যুগের বিবর্তনে ট্রাক্টর এসে এই ঐতিহ্যকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করেছে। আধুনিক বিনোদনের জায়গায় পালাগান ও যাত্রাপালা হারিয়ে গেছে অনেক আগে। মাটির হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবহার এখন আর নেই। প্লাস্টিক ও স্টিলের বিকল্প পণ্য এগুলোকে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। বড় বট গাছের নিচে, নদীর ধারের মেলা গুলোর অস্তিত্ব আর নেই। ঐতিহ্যবাহী পোষাক হিসেবে তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গির জায়গায় এসেছে মেশিনে তৈরি পণ্য।
নগরায়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তি গ্রামকে অনেকদিক থেকে পরিবর্তন করেছে। ফসল উৎপাদনে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, গ্রামীণ যুবকদের শহরে পাড়ি দেওয়া, এবং ইন্টারনেট ও টেলিভিশনের কারণে ঐতিহাসিক বিনোদনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূমি ধসের মতো ভৌগোলিক প্রভাবও গ্রামের ঐতিহ্য নষ্ট করেছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে চড়াঞ্চলের জনজীবন, তাদের নিজস্ব ঔতিহ্য আজ আর নেই। নদী অঞ্চলে আগেকার দিনের সুখ-শান্তির বিপরীতে এখন শুধুই হাহাকার।
গ্রামীন ঔতিহ্য রক্ষায় আমাদের এখন থেকে কাজ করতে হবে। গ্রামীণ মেলা ও উৎসব পুনরায় চালু করে আমরা গ্রামীন সংস্কৃতিগুলো সংরক্ষণ করতে পারি। কুটির শিল্পীদের জন্য সরকার ও এনজিওদের পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করতে পারলে প্রত্যন্ত এলাকায় যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব ঠিক তেমনই গ্রাম বাংলার হারানো ঔতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা যাবে। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঐতিহ্যিক শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে গ্রামীণ পর্যটন বাড়ানো, পাশাপাশি নিজ মনে গ্রাম বাংলার সেই সংস্কৃতি ও ঔতিহ্যকে ধারণ করতে পারলে হারানো সেইসব গ্রামীন ঔতিহ্যগুলো আবারো ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলার গ্রামীণ জীবন ও ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম মূল স্তম্ভ। এটি কেবল অতীতের গল্প নয়, বরং আমাদের শিকড়। বর্তমান প্রজন্ম যদি এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সচেষ্ট না হয়, তবে আমরা একটি অমূল্য ইতিহাস হারিয়ে ফেলবো। তাই আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গ্রামীণ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে এবং তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।
কেকে/এএম