২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে যে কোটা বৈষম্যের জন্য আবু সাঈদ-মুগ্ধরা জীবন দিয়েছেন, সে কোটাব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে অমীমাংসিত। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির নিয়োগে সকল সেক্টরে পোষ্য কোটা পুরোপুরি বাতিল হবে কিনা তা এখনো সমাধান হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে করা ৭ শতাংশ কোটা পদ্ধতি সংস্কার করার আলোচনা উঠলেও এটিও এখন চাপা পড়েছে। তাই বলা যায় -‘এখনো অমীমাসিংতই রয়ে গেছে কোটাব্যবস্থা’।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ-ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও পোষ্য কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানরা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র বলছে- পোষ্য কোটাধারীদের সুযোগ করে দিতে রাবিতে কোটা নীতিমালা পরিবর্তন করে পাস নম্বর ৪০ থেকে কমিয়ে ৩০ করা হয়েছে। আর এতে সুবিধা নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মালী, কর্মকর্তা ও অধ্যাপকরাও। এদিকে ভর্তি পরীক্ষায় পোষ্য কোটার বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত না আসার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লাল কার্ড দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা। রোববার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করেন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে পোষ্য কোটা বাতিলের জন্য বেশ জোরালো দাবি তুলছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা মানববন্ধন, স্মারকলিপি, এমনকি আমরণ অনশন করলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। তাদের অভিযোগ-শিক্ষকরা এ কোটার পক্ষে থাকায় তা বাতিল করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারসহ বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেকেই।
ইতোমধ্যে পোষ্য কোটা বাতিল চেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকের এক পোস্টে লিখেছেন, ‘পোষ্য কোটা নামক তেলা মাথায় তেল দেওয়া কালচার অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।’ এদিকে প্রাথমিক প্রাথমিকে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে কোনো পোষ্য কোটা থাকবে না বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা।
অন্যদিকে ভিসি কোটা বাতিলসহ চার দাবিতে গতকাল মানববন্ধন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন্ন ভর্তি পরীক্ষায় ভিসি কোটা বাতিল, পোষ্য কোটার যৌক্তিক সংস্কার, অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা ও আবেদন ফি কমানোর চার দফা দাবিতে একদল শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধন করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তিতে পোষ্যকোটা বাতিলের দাবিতে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে পোষ্য কোটার যৌক্তিকতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করেছেন। তবে স্নাতক পর্যায়ে পোষ্য কোটা ভর্তির তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজে পোষ্য কোটায় ভর্তির হার আরো বেশি। স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি প্রক্রিয়ায় কোটা শতকরা ৪ শতাংশ থাকলেও স্কুল পর্যায়ে ভর্তিতে এই কোটার হার ৮৭ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এখানে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য। ক্যান্টনমেন্ট স্কুলগুলোতে যেমন সেখানকার নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সন্তানরাই লেখাপড়া করতে পারেন। সেই একই উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তবুও বাইরের কিছু শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। যদিও সেটা খুবই নগণ্য। তবে বর্তমান ছাত্রনেতারা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পোষ্য কোটা রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এখানে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য। ১৯৬৬ সাল থেকে পোষ্য কোটার জন্য আলাদা আলাদা বরাদ্দ রাখার বিষয়ে নীতিমালা রয়েছে। সেই অনুযায়ী পোষ্য কোটা নিয়েই ভর্তি চলছে। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল এখানকার যারা শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তাদের সন্তানরা পড়ালেখা করবে।
রোববার (৮ ডিসেম্বর) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ‘গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে এ মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আবেদন কার্যক্রম আগামী ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে চলবে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এবারের পরীক্ষায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি কোটা বাতিল করা হয়েছে। মানববন্ধনে নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শোয়াইব হাসানের সঞ্চালনায় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জিয়া উদ্দিন, ইতিহাস বিভাগ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) শাকিল আলী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম, গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আবদুর রশিদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
মানববন্ধনে ইতিহাস বিভাগ ছাত্র সংসদের ভিপি শাকিল আলী বলেন,‘যাদের টাকা আছে, তারা একটা হ্যালোর মাধ্যমে ভিসি কোটায় ভর্তি হচ্ছে। এটার কোনো দরকার নেই। ভিসি কোটা একটা অযৌক্তিক কোটা, অথর্ব কোটা। আমরা দেখেছি, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিটন পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়ে মাদক, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিল। তার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে গেছে। এটার অবিলম্বে যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে।
আবদুর রশিদ বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যমূলক কোটা দূর করতে আন্দোলন করছেন। প্রশাসন বিভিন্ন সময় মৌখিক আশ্বাস দিলেও এখনো প্রশাসনিকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করেনি। তাদের খুবই কষ্ট লাগে, যখন গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে এসে এসব কোটার জন্য আবার দাঁড়াতে হয়। তারা দ্রুত এ কোটা বাতিলের দাবি জানান।
এদিকে পোষ্য কোটার সমালোচনা করে সংশ্লিষ্টরা বলেন, কোটা চালু হয়েছিল সমাজের বিভিন্ন অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। অথচ, পোষ্য কোটাকে এমন জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে গরীব, মেধাবী, সৎ ও যোগ্য শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও যোগ্যতাকে মূল্যহীন প্রমাণ করা হচ্ছে। যে পরিবারে একজন চাকরি করে, সেই পরিবার এমনিতেই স্বাবলম্বী। তাহলে কীভাবে তাকে অনগ্রসর বলব? সে শুধু কীভাবে পোষ্যকোটার ভিত্তিতে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখে? বলেও প্রশ্ন রাখেন।
কেকে/এমএস