সফলতার গল্পে নারীর অবদান অবিস্মরণীয়। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার হিরালদী গ্রামের বেগম সামর্তবান তেমনই এক সংগ্রামী নারী, যিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সন্তানদের সুশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তার এই সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন ফরিদপুর জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা।
দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন শুরু করেছিলেন বেগম সামর্তবান। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এই নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যান ভাঙ্গা উপজেলার হিরালদী গ্রামের হাজী আব্দুল করিম মিয়ার সঙ্গে। কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল যৌথ পরিবারে তাকে সামলাতে হয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ।
সংসার সামলে নিজের ৯ সন্তানকে সুশিক্ষিত ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এক সন্তানের অকালমৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও বাকি সন্তানদের মানুষ করার লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি। নানা বাধা ও কুসংস্কারের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি সন্তানদের শিক্ষার আলো দিতে সক্ষম হন।
আজ তার ৮ সন্তানই উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে নজরুল ইসলাম আমেরিকায় বসবাসরত, দ্বিতীয় ছেলে মো. শহীদুল ইসলাম সরকারি চাকরিজীবী, সেঝো ছেলে ওবায়দুর রহমান ও কনিষ্ঠ ছেলে মো. রফিকুল ইসলামও পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জন করেছেন। তার মেয়েরাও উচ্চশিক্ষিত এবং তাদের সন্তানরাও প্রতিষ্ঠিত।
বেগম সামর্তবান একান্তভাবে বিশ্বাস করেন, “প্রতিটি সংকটের মধ্যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়”, আর তার জীবন তাই তার এই বাণীর জ্বলন্ত উদাহরণ। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সামর্তবান তার শিক্ষা জীবন শুরু করতে পারেননি নানা ধরনের আর্থিক অসুবিধা এবং কুসংস্কারের কারণে। তবে, তার জীবন সংগ্রাম শুরু হয় যখন তিনি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার হিরালদী গ্রামে হাজী আব্দুল করিম মিয়ার সঙ্গে সংসার জীবন শুরু করেন। তাদের পরিবার ছিল কৃষি কেন্দ্রিক এবং বিশাল একটি যৌথ পরিবার ছিল তাদের।
বেগম সামর্তবান তার সংসারের অনেক দুঃসময়ে পতিত হলেও, তিনি তার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকেন। তিনি অটুট মনোবল নিয়ে নিজের সন্তানদের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন, কারণ তার জীবনদৃষ্টি ছিল, “যতই পরিস্থিতি খারাপ হোক, সন্তানদের শিক্ষায় ব্যর্থতা নয়, বরং সফলতা অর্জন করতে হবে।” তিনি ৯ সন্তানকে শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইস্পাত কঠিন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিলেন। যদিও একটি সন্তান তার অল্প বয়সে ইন্তেকাল করে, তবুও তিনি তার বাকী ৮ সন্তানকে এগিয়ে নিয়ে যান।
বেগম সামর্তবান এবং তার স্বামী মিলে তার পরিবারকে আগলে রেখেছেন, আর তাদের সংসারে নানা ধরনের সামাজিক এবং আর্থিক সংকট সত্ত্বেও, তারা কখনোই তাদের সন্তানদের শিক্ষার দিকে ছাড় দেননি। তার পরিশ্রমের ফলে, আজ তার সন্তানরা একে একে প্রতিষ্ঠিত। তার বড় ছেলে নজরুল ইসলাম, মেঝো ছেলে শহীদুল ইসলাম, সেঝো ছেলে ওবায়দুর রহমান, এবং অন্যান্য সন্তানরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল। তার পুত্রবধূরাও নিজেদের কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
তার জীবনের সংগ্রামী পথের কাহিনী এবং তার প্রেরণাদায়ক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ফরিদপুর জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। তার অসামান্য অবদানের জন্য জেলা প্রশাসন এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা পদক এবং সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
তার জীবন সংগ্রামের শুরুর দিকে, সমাজে নারীদের শিক্ষা, উন্নয়ন এবং সফলতার পথ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে তিনি অনেক বাধা এবং প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বিশেষ করে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সমাজে নেতিবাচক মনোভাব ছিল। কিন্তু তিনি তার সাহস এবং দৃঢ়চেতা মনোভাবের মাধ্যমে তার সন্তানদের শিক্ষিত করতে সক্ষম হন এবং আজ তার সন্তানরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বেগম সামর্তবান আজকের দিনে সমাজ উন্নয়নে আরও অবদান রাখতে চান এবং তার কাজের পরিধি বাড়াতে চান। তিনি 'হাজী আব্দুল করিম ও সামর্তবান ফাউন্ডেশন' নামে একটি অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা সমাজের দরিদ্র এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য করছে। এই ফাউন্ডেশনটি এলাকার মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করছে, গ্রামের অতি দরিদ্র নারীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে, এবং অন্যান্য সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
তিনি আরও বলেন, “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো আমার সন্তানদের সফল করা এবং তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা। এখন আমি চাই, আমার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত করতে এবং তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে।” তার এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইতিমধ্যে সেলাইমেশিন বিতরণ, অটোভ্যান বিতরণ, শীতার্তদের জন্য কম্বল বিতরণ, এবং বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ বিতরণের কাজ চলছে। এছাড়া অন্যান্য সামাজিক কাজ যেমন গ্রাম্য পথচারীদের জন্য ল্যাম্পপোষ্ট স্থাপন এবং মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে।
বেগম সামর্তবান আজকের সমাজের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। তার জীবনযাত্রা এবং সামাজিক কাজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সঠিক মনোভাব এবং কঠোর পরিশ্রমে কোনো বাধাই জয় করা সম্ভব। তার সংগ্রামী জীবন এবং মানবিক উদ্যোগ বর্তমান সমাজে নারীদের সক্ষমতা এবং শক্তির প্রতীক।
তার এ অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বেগম সামর্তবান এ বছর জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। তার সাফল্যের গল্প শুধু তার জীবন নয়, সমাজের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস।
কেকে/এএম