মানুষ কি কেবল নিজের চাহিদা পূরণের জন্যই বেঁচে থাকে, নাকি এর বাইরে আরও গভীর কোনো উদ্দেশ্য তাকে পরিচালিত করে? আব্রাহাম ম্যাসলো তার চাহিদার সোপানতত্ত্বে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে একমাত্রিকভাবে উপস্থাপন করলেও, বাস্তব জীবনে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক চাহিদা ছাড়িয়ে সম্পর্ক, আত্মত্যাগ, এবং মানবিক মূল্যবোধের জন্য কাজ করে। তাই মানুষের জীবনধারা ও চেতনার এই বহুমাত্রিক দিককে অন্বেষণ করা জরুরি।
ঐতিহাসিকদের মতে, মানুষের জীবনধারার চালিকাশক্তি চাহিদার সোপানের মতো সরল নয়। কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে বলা হয়েছে, মানুষের সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থাই তার চিন্তা ও কর্ম নির্ধারণ করে। মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, শ্রমিকরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলেও বিপ্লবের জন্য একত্রিত হয়, যেমনটি ফরাসি বিপ্লবে দেখা গেছে। সেখানে জনগণ অর্থনৈতিক বঞ্চনার মধ্যেও স্বাধীনতা এবং সাম্য অর্জনের জন্য লড়াই করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, সামাজিক ন্যায়বিচার বা রাজনৈতিক অধিকার কখনো কখনো মৌলিক চাহিদার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আব্রাহাম মাসলোর তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্যক্তি আগে তার মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, আশ্রয় এবং নিরাপত্তা পূরণ করে, তারপর উচ্চতর চাহিদা যেমন মর্যাদা বা আত্ম-অভিজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর জীবন আমাদের অন্য চিত্র দেখায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের সময়, গান্ধী খাদ্য, আরাম বা নিজের শারীরিক নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে একটি বৃহত্তর মানবিক আদর্শের জন্য লড়াই করেছেন। তাঁর বহুবার অনশন এবং কারাবাস এই সত্যকে প্রমাণ করে। গান্ধীর আত্মত্যাগকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ বলেন, ‘গান্ধী ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন।’
মাসলো'র তত্ত্ব বুঝাতে চায় মানুষ একমাত্রিক জীব, যে কিনা নিজের চাহিদা পুরন করে বুঝে শুনে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়, যেখানে সমাজ, দেশ ও সামস্টিকতার ঊর্ধ্বে স্থান পায় ব্যক্তির নিজের বাসনা পুরণের মানসিকতা। এর মানে মানুষ এমন এক আত্মকেন্দ্রিক জীব যে নিজের ইন্দ্রিয় আর বস্তুগত চাহিদা পুরণ হলে চায় বড় কিছু হতে, অমরত্বও চায় আত্ম আকাঙ্খার চেতনায়। মূলত মানুষ একমাত্রিক নয়, দ্বিমাত্রিক সত্তা। সকল মানুষের কর্ম একই আকাঙ্ক্ষার ছকে বাঁধা থাকে না, বরং মানুষের আকাঙ্ক্ষার ছক পরিবর্তিত হয় ধ্যান ধারনা ও মতাদর্শ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
আত্মকেন্দ্রিকতার সিঁড়ি পার হয়ে সাময়িক মর্যাদা বা বড় কোন পদে আসীন হওয়া যেতে পারে, তবে মহান হওয়া যায় না। হিটলার, ওবামা, অংসাং সুচি, আরাফাত একেক দেশে গ্রেট হতে পারে, তবে মহান হতে পারেনি, ফলে অমরত্ব লাভের বাসনা বিফলে যেতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- মানুষের রয়েছে দুই বিপরিত সত্তা ; ১ জীব সত্তা ২ বিশ্ব সত্তা, বিশ্ব সত্তার অধিকারী হতে হলে জীব সত্তাকে দুর্বল করতে হয়। কবি নজরুল বলেন- হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান। এর মানে জীব সত্তাকে সবল করে মহান হতে পারেনা। তাছাড়া মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে যে শুধু ব্যক্তি কেন্দ্রিক তাও নয়, যে নারী একসময় নিজের খাওয়া আর নিজের আরাম কে চিনতো , সে নারী সন্তানের জন্য ঘুম ত্যাগ করে, অভাবী হলে নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়, সন্তানের নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন থাকে-ভুলে যায় নিজের বিষয়াদি।
এর মানে মা নিজের বস্তুগত কামনা বিসর্জন দেয় সম্পর্কের অধিকারের প্রশ্নে। আবার এমন উদাহরনের অভাব নেই, যেখানে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে হারানোর বেদনায় নিজের খাওয়া আরাম ত্যাগ করে, কেউবা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এর মানে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ভুলিয়ে দেয় জৈবিক চাহিদার অনুভুতি। ঠিক তেমনি যার মধ্যে দেশপ্রেম প্রবল, সে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে, ভুলে যায় তার ভালো খাওয়ার, আরামে থাকার ইচ্ছাগুলো। বহু দরিদ্র মানুষ মধ্যবিত্ত না হয়েই জীবন বিসর্জন দেয় দেশের মুক্তির জন্য, সামস্টিক অধিকার পুরণের জন্য।
এমন মানুষও আছে, যারা বলে প্রয়োজনে মারা যাব তবুও অত্যাচারী দানবের কাছে মাথা নত করবনা। এ ধরণের চেতনা যারা লালন করে তারা নিশ্চয়ই অধিক বছর বাঁচা , আরামে থাকা আর নিজের নিরাপত্তার উপরে স্থান দেয় স্বাধীনতা আর মানবিক অধিকারকে। ধরুন কেউ আপনার মাকে বা সন্তান কে হত্যা করতে উদ্যত হল, আপনি কি চেয়ে চেয়ে দেখবেন এই ভেবে যে এখনো তো আমার জৈবিক চাহিদাগুলো পুরন হয় নি- তাই কি আর করা নিজেকে ঝুকিতে কেন ফেলব। অথচ সমাজে এমন উদাহরণ আছে নিজের বোনের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আপন ভাই নিজ জীবন হারানোর ঝুকি নেয়। মুলত মানুষের জীবনধারার চালিকা শক্তি মানুষের চেতনা, যে চেতনা আবেগের ধরণ, অনুকরণ প্রবনতা, চিন্তা, চিন্তার গভীরতা, জ্ঞানের মাত্রা, জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের মান, বিশ্বাসগত কাঠামো, আত্মপরিচয়ের ধারনার ভিন্নতা আর মতাদর্শের প্রতি প্রেম ও অনুরক্ততার উপর নির্ভর করে চলে।
মাসলো'র তত্ত্বটি একটি স্থির এবং সার্বজনীন মডেল নয় বরং মডেলটি লিনিয়ার এবং ধারাবাহিকভাবে এক স্তর থেকে আরেক স্তরে উত্তরণের ধারণা দেয়।
তবে, গবেষণাগুলো প্রমাণ করে যে মানব চাহিদাগুলো প্রায়ই একই সময়ে সক্রিয় থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি খাদ্যাভাবে থাকলেও সামাজিক সংযোগ বা আত্মসম্মানের জন্য লড়াই করতে পারে। ক্রস-সাংস্কৃতিক গবেষণাগুলোও দেখিয়েছে যে ভিন্ন সংস্কৃতিতে মানুষের প্রয়োজনের অগ্রাধিকার ভিন্ন হতে পারে।তত্ত্বটি গবেষণামূলক প্রমাণের অভাবযুক্ত মাসলো তার তত্ত্বটি প্রাথমিক পর্যায়ে সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিনিধি। এটি সার্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সমর্থিত নয়।
আব্রাহাম মাসলো'র চাহিদা সোপান তত্ত্ব মানব প্রেরণা বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এটি বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এর লিনিয়ার কাঠামো, গবেষণার অভাব, এবং সংস্কৃতিগত ভিন্নতার প্রতি সংবেদনশীলতার অভাবের কারণে এটি আজকের দিনে মনোবিজ্ঞান ও মানব উন্নয়ন তত্ত্বের জন্য একমাত্র মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। মানব চাহিদার জটিলতা ও বহুমাত্রিকতাকে সম্পূর্ণভাবে ধারণ করতে ব্যর্থ। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক সত্তা হলেও, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক কারণগুলো তাদের চাহিদা ও কর্মকাণ্ডকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের জীবনধারা কেবল চাহিদার সোপানে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সম্পর্ক, মূল্যবোধ, এবং বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে।
কেকে/এমএস