রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টে রিং বাণিজ্য ও অর্থ আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগের পিছনের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে খোলা কাগজের অনুসন্ধানে। পূর্ব শত্রুতার জেরে একটি মহল এই চিকিৎসককে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে অভিযোগ করিয়েছিলেন। এছাড়াও অভিযোগকারীদের অভিযোগপত্রেও পাওয়া গেছে নানা গড়মিল।
জানা যায়, গত ৩ ডিসেম্বর ডাকযোগে ভুক্তভোগী পরিচয়ে দুইজন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টের রিং বাণিজ্য ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দেন হাসপাতালটির পরিচালক বরাবর। একইদিন আতোয়ার হোসেন ও মো. মশিউর রহমান নামে এই দুই অভিযোগকারী দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিএমডিসি, রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ বিভিন্ন দফতরে সরাসরি ও ডাকযোগে অভিযোগের কপি পাঠান। ৫ ডিসেম্বর বিষয়টি জানাজানি হলে- একটি রিং পরিয়ে তিনটি রিং-এর টাকা নেন ডা. মাহাবুবুর রহমান, এই শিরোনামে সংবাদ প্রচার হয় কিছু গণমাধ্যমে। প্রচার হয় এর প্রতিবাদ লিপিও। এরপরই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে রংপুরসহ সারা দেশে। তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে।
তবে সেই অভিযোগকারীদের অভিযোগপত্রের গড়মিলের সূত্র ধরে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দুই অভিযোগকারীর মধ্যে একজন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মশিউর রহমান। তার অভিযোগ ও অন্যান্য কাগজপত্রে দেখা যায়, তিনি যে অভিযোগপত্র লিখেছেন সেখানে উল্লেখ করেছেন, ডা. মাহবুবুর রহমান হার্টে ব্লকের কথা বললেও গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ঢাকা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে গিয়ে জানতে পারেন তার মায়ের হার্টে কোন ব্লক নেই। অথচ তিনি অভিযোগের তারিখ দিয়েছেন ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। অর্থাৎ ডাক্তার দেখানোর আগেই তিনি জেনেছেন হার্টে ব্লক না থাকার কথা। ঢাকায় যে ডাক্তার দেখিয়েছেন সেটির কাগজপত্র দেখাতে চাইলেও তিনি কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। এছাড়াও রংপুরে যে ডাক্তারকে দেখিয়েছেন সেই প্রেসক্রিপশনের তারিখ কাটাকাটি। এসব অসঙ্গতিগুলো নিয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী মশিউর রহমান এক পর্যায়ে স্বীকার করেন যে, তাকে দিয়ে এসব অভিযোগ করানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাকে এসব করতে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হক।
এদিকে, অনুসন্ধানে উঠে আসে আরেক অভিযোগকারী আতোয়ার হোসেনও প্রমাণ ছাড়াই ডা. মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টে তিনটি রিং পরানোর নামে একটি রিং পরানোর অভিযোগ তোলেন। প্রকৃত ঘটনা হল, একটি রিং পরানোর পাশাপাশি হার্টের বাম দিকে রক্তনালিতে একটি ড্রাগ কোর্টেট বেলুন লাগানো হয়েছে যার ডকুমেন্টসও রয়েছে। আর এই ভুল অভিযোগকারী আতোয়ারকেও একইভাবে সহযোগিতা করেছেন মাহমুদুল হক।
অভিযোগকারী আতোয়ার রহমান বেরোবির সেই শিক্ষক মাহমুদুল হকের সহযোগিতার কথা স্বীকার করে বলেন, ঊনি আমাকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছে।
দুই অভিযোগকারীর এমন বক্তব্যের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডা. মাহমুদুর রহমান ও মাহমুদুল হক একই বিল্ডিং এর নিজস্ব ফ্লাটে বসবাস করেন। নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় গত ১০ নভেম্বর। রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগও দেন তারা। এর ঠিক ২২ দিন পর গত ৩ ডিসেম্বর রংপুর কেন্দ্রীয় পোস্ট অফিসে একই সঙ্গে অভিযোগ করেন দুই অভিযোগকারী।
অন্যদিকে, রংপুর মেডিকেলের কার্ডিওলজি বিভাগের ক্যাথল্যাব বিভাগের চিকিৎসকের নামে এমন অভিযোগে নড়ে চড়ে বসে পুরনো দালাল সিন্ডিকেট। সুযোগের সৎ ব্যবহার করে ফায়দা লোটার চেষ্টায় মেতে উঠেন তারাও। কেননা ডা. মাহাবুবুর রহমানকে সরিয়ে আগের মতো ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে কমিশন মিলবে তাদের।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেরোবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হক খোলা কাগজকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কথা বলার কিছু নেই। ভিকটিমকে যে কেউ হেল্প করতে পারে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মাহাবুবুর রহমান বলেন, চিকিৎসার সব কিছু রেকর্ড ও ডকুমেন্টস থাকায় কারচুপির কোন সুযোগ নেই। কতগুলো রিং পড়িয়েছি এবং কত টাকা নিয়েছেন তারও ডকুমেন্টস রয়েছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।
প্রসঙ্গত, ডা. মাহবুবুর রহমান গত দেড় বছরে ৬ শতাধিক এনজিওগ্রাম করার পাশাপাশি হার্টে শতাধিক রিং ও পঞ্চাশটির বেশি পেসমেকার বসিয়েছেন। যার মধ্যে সফলতা পেয়েছেন ৯৯ দশমিক ২ ভাগ।
কেকে/এইচএস