প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্যমত সংক্রান্ত কমিশন গঠনের ধারণাকে স্বাগত জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেছেন, সরকারের কাজের গতি ও দক্ষতা থাকলে ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ২০২৫ সালের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব।
নেতারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে জাতীয় নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। বাতিল হওয়া স্থানীয় পরিষদের কাউন্সিলরদের পুনর্বাসনের কোনো সুযোগ নেই বলেও মনে করেন নেতারা।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডের শিশু কল্যাণ ভবনে নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে নেতারা এসব কথা বলেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এতে দেশবিরোধী অপতৎপরতার প্রতিবাদে ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর দাবিতে আগামী ২৪ ডিসেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। ওইদিন বেলা ১১ টায় পুরানা পল্টন মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার উচ্চ আদালতের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কয়েকটি ধারা বাতিল সংক্রান্ত রায়কে স্বাগত জানিয়ে নেতারা বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে সংবিধানে জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হলো। নেতৃবৃন্দ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাস্তবে প্রশাসনে স্থবিরতা চলছে। একশ্রেণীর আমলারা ব্যক্তিগত এজেন্ডা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত রয়েছে।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ ও অকার্যকরী করে তুলতে বহু আয়োজন চলছে, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ও নানা অশুভ চক্র। এসব বিবেচনায় রেখেই সরকারকে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে হবে।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হককে গ্রেফতারের ঘটনা ষড়যন্ত্রমূলক উল্লেখ করে ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা অবিলম্বে আইনানুগভাবে তার মুক্তির দাবি করেন। তারা বলেন, চার বছর আগে অবসরে যাওয়া মহিবুল হককে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলসমূহের মহাসমাবেশে এক হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার বাদি আদালতে উপস্থিত হয়ে তার মামলার সঙ্গে মহিবুল হকের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথা জানিয়ে হলফনামা দিলেও গত একমাসে তার জামিন হয়নি। তিনি যাতে জামিনে ছাড়া না পান তার জন্য ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে এক নিহতের মামলায়ও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
নেতারা বলেন, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই সরকারি পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে মহিবুল হককে অন্যায়ভাবে জেলে পুরে রাখা হয়েছে। এ ধরনের হয়রানিমূলক প্রতিশোধাত্বক মামলা চলতে থাকলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বিশেষ কোনো দিকে ঝুঁকে না পড়ে সরকারকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বাতিল হওয়া স্থানীয় পরিষদের কাউন্সিলরদেরকে পুনর্বহাল করার তৎপরতায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এভাবে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির দোসরেরা আবার পুনর্বাসিত হবে। তিনি এসব তৎপরতা বন্ধের দাবি জানান।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়কে অভূতপূর্ব সুযোগ বলে উল্লেখ করে মান্না বলেন, অভূতপূর্ব সুযোগ নিজেদের ভুলে যদি নষ্ট করে ফেলি, তাহলে ফিরে পেতে অনেক সময় লাগতে পারে।
মান্না বলেন, কতগুলো নীতিতে আমাদের একমত হতে হবে। যেমন আমরা গণতন্ত্র উত্তরণে এ নীতি অনুসরণ করবো। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটা পথনির্দেশিকা দিয়েছেন। কেউ বলতে পারেন ছয় মাস বেশি নেওয়া হয়েছে, আরও কমানো যেতে পারে। কনক্রিট সাজেশন বলেন। অথবা এমনভাবে বলেন, যাতে একটা কন্ট্রাকটিভ জায়গায় যেতে পারে। না হলে কিন্তু ভুল–বোঝাবুঝি হবে। যত বেশি বিভেদ হবে, ততই আমাদের আস্থা নষ্ট হবে।
গুম কমিশনের রিপোর্টে ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের এমন ভয় আছে, হয়তো একসময় মানুষ মনে করবে বিচারগুলো না হলে কিসের ভোট। খোদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসব গুম-খুনের হুকুমদাতা, এসবও বলা হয়েছে। তার বিচার না করে তো যাওয়া যাবে না।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে, এখন পর্যন্ত পুলিশ ঠিক হয়নি, জনপ্রশাসনও ঠিক হয়নি। উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, তাবলিগ জামাতের চারজনকে হত্যা করা হলো। অভ্যুত্থানে যারা অগ্রভাবে ছিলেন, তাদের গাড়িচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপর মানুষের বিপুল প্রত্যাশা। তারা যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে তাদের দলনিরপেক্ষতা হারান তাহলে তাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তিনি রাজনৈতিক দলসমূহসহ সবাইকে আস্থায় নিয়ে সরকারকে সংস্কার, জাতীয় নির্বাচনসহ দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা নিশ্চিত করার আহবান জানান।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানান ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আর যাতে কাদা-ছোড়াছুড়ি না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে নীতিমালা করতে সরকার ও প্রধান বিচারপতির কাছে আহ্বান জানান তিনি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, সংস্কার ছাড়া গতানুগতিক নির্বাচন দিয়ে দেশ এগুতে পারবেনা। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সংস্কার প্রয়োজন।
গণ সংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল বলেন, গণ অভ্যুত্থানের সংগঠকেরা গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছেন। গণঅভ্যুত্থানের সংগঠকদের নিরাপত্তাসহ জনগণের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।
আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি এখনো ঠিক হয়নি উল্লেখ করে আবুল হাসান পুলিশের সংস্কার করতে ট্রুথ কমিশন গঠন এবং ভারতের গুজব সন্ত্রাস রোধ করতে সরকারকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান।
কেকে/এমআই