একদিকে গৃহযুদ্ধ, অন্যদিকে দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি। এমন পরিস্থিতিতে পেটের খাবার জোগাতে মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকদের বেহাল অবস্থা। পেটের জ্বালায় অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বেআইনি পথ। বাদ নেই নারী চিকিৎসক ও নার্সরা। সংসারের জন্য দেহব্যবসায় নেমেছেন তাদের একাংশ।
মার্কিন সংবাদ সংস্থা নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত তিন-চার বছরে মিয়ানমারে যৌনকর্মীর সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশি আয়ের আশায় এই পথে নামছেন নারী চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষিকারা। অধিকাংশই এ কাজ করছেন পেটের দায়ে। তবে এ ব্যাপারে কোনও হেলদোল নেই সেখানকার সামরিক জান্তা সরকারের।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। ২০২০ সালে শুরু হওয়া কোভিড মহামারীর ধাক্কা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব। ওই সময়ে এমনিতেই দেশের আর্থিক অবস্থা ছিল নড়বড়ে। তার মধ্যে জান্তা সরকার ক্ষমতা নেওয়ায় দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায়।
গৃহযুদ্ধ ও কোভিডের কারণে গত তিন বছরে হু-হু করে নেমেছে অর্থনীতির সূচক। মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গিয়েছে ২৬ শতাংশে। ফলে বাজারে আগুন দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। আগামী ২০২৫ সালে মিয়ানমারের আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
দেশের এই দুর্বিষহ অবস্থার কথা নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে তুলে ধরেছেন সদ্য চিকিৎসক হিসেবে ডিগ্রি পাওয়া ২৬ বছর বয়সী মিয়ামারের তরুণী মে। তার কথায়, ‘৪১৫ ডলার হাতে থাকলে মুহূর্তে তা শেষ হয়ে যাবে। ওই টাকায় আজকাল আর পানিও পাওয়া যায় না। পরিবারের নিত্য দিনের খরচ চালানোই দায়। আমাদের কাছে রোজগারের একমাত্র রাস্তা হলো যৌন ব্যবসা।’
মিয়ানমারের খারাপ আর্থিক অবস্থার নেপথ্যে আরও কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন আর্থিক বিশ্লেষকরা। তার মধ্যে রয়েছে বর্ষা পরবর্তী ঋতুতে অতিবৃষ্টির জেরে বন্যা। এতে কৃষির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া চীন এবং থাইল্যান্ড সীমান্তে বিদ্রোহীরা অতিরিক্ত সক্রিয় থাকায় আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য এক রকম বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
চলতি বছরে মিয়ানমারের স্থানীয় মুদ্রা ‘কিয়াট’-এর বিপরীতে ডলারের দাম দুই-পঞ্চমাংশ কমেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশটির অর্ধেকের বেশি নাগরিক দারিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছে। ২০১১-২১ সালের মধ্যে চলা গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে মিয়ানমারে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। ওই শ্রেণির জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হলো মান্দালয়ে। যৌনকর্মীর সংখ্যা সেখানে উত্তরোত্তর বাড়ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে মে বলেছেন, ‘আমাদের এখানে দেহব্যবসা আইনত সিদ্ধ নয়। শহরাঞ্চলে, বিশেষত যেখানে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে, সেখানে ‘ডেট গার্ল’দের দেখা মিলবে। এরা প্রত্যেকেই যৌনকর্মী। পেটের জ্বালায় ডেটিংয়ের নামে এই পেশায় নেমেছেন তাঁরা।’
মিয়ানমারে গত তিন বছরে ঠিক কতজন যৌনকর্মীর জীবন বেছে নিয়েছেন, সেই সংখ্যা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, তথাকথিত ভাল চাকরি বা কাজ ছেড়ে এতে নাম লেখাচ্ছেন তরুণীদের একাংশ। অনেকে আবার উপরি রোজগারের জন্য যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিয়েছেন। শিক্ষিত মেয়েদের এ দিকে ঝোঁকার প্রবণতা বেশি বলে জানা গিয়েছে।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে মেয়েরাই প্রথম রাস্তায় নেমেছিলেন। জান্তার সৈনিকদের সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় উড়িয়ে বিক্ষোভে সামিল হন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার। সেগুলোর দখল নিয়েছে বিদ্রোহীরা। তবে দেশের মূল শহরগুলো জান্তার দখলেই রয়েছে। আর সেখানে দিন দিন বাড়ছে যৌনপল্লীর সংখ্যা। কারাওকে পানশালা, নাইটক্লাব এবং হোটেলে চুটিয়ে চলছে এই দেহব্যবসা।
এই ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে আরও খোলামেলাভাবে কথা বলেছেন ২৫ বছর বয়সী জার নামের এক তরুণী। তার কথায়, ‘যৌন ব্যবসায় এক রাতে ৮০ ডলার পর্যন্ত উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। মাসের হিসাবে টাকাটা অনেকটাই বেশি। আমাদের খদ্দেরদের অধিকাংশই চীনা নাগরিক। ভাঙা ইংরেজি এবং বার্মিজ ভাষায় কথা বলতে পারেন তারা। অবশ্যই কাজটা ভাল নয়। প্রথম প্রথম এর জন্য লজ্জাও পেতাম। তবে এখন টাকাটা প্রয়োজন।’
মান্দালয়ের একটি সেনা হাসপাতালে নার্স ছিলেন জার। ধনী খদ্দেরের হদিস পেতে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এই পেশায় পদে পদে রয়েছে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়। তবে ধরা পড়লে ঘুষ দিয়ে শাস্তি এড়ান মিয়ানমারের যৌনকর্মীরা।
মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লক্ষ। দেশটিকে সেনা শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়নমূলক কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর ডিম ও দাঁত মাজার পেস্টের মতো সামগ্রীগুলোর দাম প্রায় তিনগুণ হয়েছে। অন্য দিকে কমেছে আমজনতার রোজগার।
আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, মিয়ানমারে সাধারণ খাবারের খরচ ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। এ বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে চলা একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশটির নারী শ্রমিকরা দিনে গড়ে মাত্র পাঁচ ডলার উপার্জন করেন। সেখানে একই কাজ করে পুরুষদের আয় পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেশি।
মিয়ানমারের নারীদের কর্মসংস্থানের একটি বড় জায়গা ছিল দেশের বস্ত্রশিল্প। ২০২৬ সালের মধ্যে সেখানকার মিল ও কাপড়ের কারখানাগুলোতে ১৬ লক্ষ নারী কর্মী নিয়োগ হবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানের পর গৃহযুদ্ধ লেগে যাওয়ায় সেই কারখানাগুলোর অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কেকে/এমআই