দেশে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে গুপ্তহত্যার ঘটনা। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে জসিম উদ্দীন নামে এক যুবক ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। তিনি বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। এছাড়া গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাজবির হোসেন শিহান ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থী ওয়াজেদ সীমান্ত দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন। উভয়েই গণঅভ্যুত্থানের সময় সক্রিয় ছিলেন।
ধারাবাহিক এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। মিছিল থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের দাবি জানানো হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি, পরাজিত শক্তি গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের টার্গেট করে হত্যার মিশনে নেমেছে। আর সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। অপরদিকে এসব গুপ্তহত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সোচ্চার হয়েছেন সাধারণ মানুষও।
টার্গেট করা হচ্ছে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় শিক্ষার্থীদের:
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সক্রিয় শিক্ষার্থীদের টার্গেট কিলিং করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী সানজিদ হাসান তানভীর। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। সেখান থেকে বের হয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি সংগঠন। তারা সাইবার স্পেস ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে। গেরিলা যুদ্ধের নামে আমাদের ওপর সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া গাজীপুরের শিক্ষার্থী সাকিবকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।’
এদিন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থী ও সমন্বয়ক কাওসার হাবিব বলেন, ‘আমাদের সহকর্মীদের বিভিন্নভাবে হামলা করা হচ্ছে। সহকর্মীরা টার্গেট কিল্লিংয়ের শিকার হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বিপ্লবীরা কেন শহিদ হবে। এসব বিষয় আমরা ট্রাইব্যুনালে এসেছি জানানোর জন্য। ওদের বলেছেন নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি আদালতে তুলে ধরবেন। আমাদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির আন্দোলনের কারণেই জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে।’
গুপ্তহত্যা প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, ‘যে বিপ্লবীদের কাঁধে ভর দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে বাংলাদেশে বিপ্লবীদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকে। বিপ্লবীদের রক্ত মাড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ক্ষেত্রে নির্বিকার-নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে। এটা অশনিসংকেত। আমাদের স্বপ্নের কথা, প্রত্যাশার কথা আপনারা ভুলে গেছেন। ছাত্র-জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে এ দেশে রাজনীতি করতে হবে।’
আবদুল কাদের আরো বলেন, ‘আমাদের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাব। গুপ্তহত্যা করে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না।’
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের উদ্বেগ, বিচার দাবিতে আল্টিমেটাম:
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার বিচার নিশ্চিত না হলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অনশনের আল্টিমেটাম করার হুঁশিয়ারি দিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের পাঁচ সক্রিয় শিক্ষার্থী হত্যার বিচার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিশ্চিত না হলে আমরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অনশন করব।’
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সক্রিয় ছাত্র-জনতার নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ছাত্র-জনতাকে অনিরাপদ করে সরকারকে নিরাপদ রাখার দায় আমাদের নাই। যদি পারেন নিরাপত্তা দেন, নইলে নির্বাচন দিয়ে সরে যান। আপনাদের ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য পাঠানো হয়নি। আপনাদের ক্ষমতায় পাঠানো হয়েছে বিচারের জন্য।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘অতিদ্রুত এসব ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। আমরা দেখছি নানা জায়গাতে শিক্ষার্থীরা গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন। এটা খুঁজে বের করা খুবই জরুরি। অভ্যুত্থানের সময় তারা মাঠের শক্তি ছিল, তারা গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে। আর সেখানে ঠিকমত সরকারের অ্যাকশন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সেখানে আসলে প্রশ্ন করতে হয়; সরকারের মূলত কারা আছে। এ গুপ্তহত্যা নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের জানাতে হবে।’
এদিকে এসব ঘটনার সমালোচনা করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে জনতাকে উত্তপ্ত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। এ ষড়যন্ত্রের প্রতিহত করতে সজাগ থাকতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘যে কোনো হত্যাই গুরুতর অপরাধ। গুপ্তহত্যায় আলামত গোপন করা হয়, যাতে করে এটি বিচারিক প্রক্রিয়ায় যেতে না পারে। এ ধরনের অপরাধকে সরকারের জোরদারভাবে দেখা উচিত। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও প্রাণের বিনিময়ে এ সরকার গঠিত হয়েছে। তাই সরকারের অনেক বেশি দায়, যারা জীবনবাজি রেখে আন্দোলন করেছে, তাদের ওপর এমন হত্যাকাণ্ড সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা কাঠামো এখনো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এজন্য সরকারকে রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থাকে ঠিক করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশের অতিরিক্ত যে ফোর্সগুলো রয়েছে সেগুলোকে একীভূত করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘যে কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড সমাজের জন্য ভয়ের বার্তা। জুলাই পরবর্তী যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি আমাদের নানা বিষয়বস্তু সঙ্গে নিয়েই চলতে হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন, রাজনীতি, নাগরিক অধিকারের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। এছাড়া জুলাই বিপ্লবের যে প্রেক্ষাপট যাদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ গণমাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। এখন জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাস্তবতা থেকে সেটি হচ্ছে কি-না সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
কেকে/এমএস