২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডে দেশের শীর্ষ বহু সেনা কর্মকর্তা প্রাণ হারান। তবে যুদ্ধ ছাড়া এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের পরতে পরতে রয়েছে ষড়যন্ত্র। নিহতদের পরিবারগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগ দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তদন্তে চাপা পড়েছে দেশি-বিদেশি চক্রান্তের তথ্য।
নবগঠিত কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান বলেন, বিমানবন্দরে আটক হয়েছেন বিজিবির সাবেক ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম। এতে নতুন করে হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নতুন তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে ছিল না দেশি-বিদেশি চক্রান্তের তথ্য।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর যে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সে তদন্তে দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কোনো প্রতিবেদন ছিল না বলে জানিয়েছেন কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান। গতকাল মঙ্গলবার এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন তথ্য জানান তিনি।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তী তদন্ত পর্যালোচনা করা হবে। প্রয়োজনে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
এর আগে গত সোমবার বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রধান করা হয়েছে বিজিবির (তৎকালীন বিডিআর) সাবেক মহাপরিচালক এ এল এম ফজলুর রহমানকে।
এদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আপনারা সব সময় চেয়েছেন বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটা কমিশন হোক। কমিশনের সদস্য সংখ্যা সাতজন। বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক এ এল এম ফজলুর রহমান এ কমিশনের সভাপতি। তার সঙ্গে আরো থাকবেন সামরিক বাহিনীর দুজন সদস্য, সিভিল সার্ভিসের একজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
পনেরো বছর আগে বিডিআর বিদ্রোহের সময় ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছেন শহিদ পরিবারের সদস্যরা।
এর আগে নভেম্বরে হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা উন্মোচনসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিলের কথা জানিয়েছিলেন শহিদ কর্নেল কুদরত এলাহীর সন্তান অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান। সেদিন ‘পিলখানায় ৫৭ অফিসারসহ ৭৪ জনের হত্যার বিচার এবং শহিদ সেনা দিবসের দাবিতে’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন, শহিদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী রবি রহমানের স্ত্রী ডা. ফৌজিয়া রশীদ ও ভাই কাজী ওলি রহমান, শহিদ কর্নেল এরশাদের ভাই ডা. মামুন, শহিদ কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান, শহিদ কর্নেল কুদরত এলাহির স্ত্রী লবী রহমান, শহিদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফুর রহমান খানের মেয়ে ফাবলিহা বুশরা, শহিদ কর্নেল মজিবুল হকের স্ত্রী নাহরীন ফেরদৌসী প্রমুখ।
‘এত বড় হত্যাকাণ্ড, যেখানে ৫৭ জন চৌকস সেনাবাহিনীর অফিসার শাহাদত বরণ করলেন তার বিচার মিলিটারি আইনে হলো না উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান। তিনি বলেন, মামলাটি দীর্ঘদিন আপিল ডিভিশনে থাকলেও সর্বশেষ পরিস্থিতি শহিদ পরিবারের সদস্যদের জানা নেই। মামলা চলাকালীন এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর্দার আড়ালের ষড়যন্ত্রকারী, যারা গত সরকারের সময় ক্ষমতায় ছিল।
তিনি আরো বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব। আন্তর্জাতিক আইনের ডকট্রিন অব কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকেও বিচারের মুখোমুখি আনা সম্ভব। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে তিনিও দায় এড়াতে পারেন না। তার বিরুদ্ধেও আমরা অভিযোগ করব। এ ছাড়া, তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা, বিশেষ করে ডিজিএফআই কর্মকর্তা যারা ছিলেন, তখনকার সময় কিছু সাংবাদিক যারা ভুল ন্যারেটিভ সৃষ্টি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা অভিযোগ আনব।
তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকীন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদ সরকার আওয়ামী লীগ চাইবে না গুম-খুনের বিচার হোক। যেহেতু এখন বাধা নেই, তাই বিডিআর সদস্য হত্যার তদন্ত দ্রুত শেষ করে জড়িতদের আইনের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হোক।
পিলখানা হত্যার দিনকে শহিদ দিবস ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জড়িতদের সাজা দিলে দেশের সব মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়াবে। হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ায় যাদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তাদের সুনির্দিষ্ট একটি ব্যবস্থা করতে হবে।
শহিদ পরিবারের পক্ষ থেকে দাবিগুলো তুলে ধরেন শহিদ কর্নেল মজিবুল হকের স্ত্রী নাহরীন ফেরদৌসী। তিনি বলেন, গ্যাজেটের মাধ্যমে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহিদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহিদ সেনা দিবস ঘোষণা করে এ দিন দেশজড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখারও দাবি জানান তিনি।
অফিসিয়াল গেজেটে নিহত ৫৭ জন বীর সেনানীকে শহিদের মর্যাদা দেওয়া ও পিলখানা ট্র্যাজেডিকে উপযুক্তভাবে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা এবং দ্রুত বিচার শেষ করে আটককৃত নির্দোষ সব মানুষকে দ্রুত ন্যায়বিচার দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বিমানবন্দরে আটক বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলামকে আটক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে আটক করা হয়।
জানা গেছে, সস্ত্রীক কানাডা যাওয়ার সময় তাকে আটক করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ওঠার কথা ছিল তার। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে আটকের বিষয়ে বিস্তারিত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর (নতুন নাম বিজিবি) বিদ্রোহ ও পিলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এ ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মাথায় বাহিনীটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান মইনুল ইসলাম। তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার পর বাহিনীটির ইউনিফর্ম পরিবর্তন হয় এবং সীমান্ত বাহিনীতে যোগ করা হয় একটি গোয়েন্দা ইউনিট। পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয় তাকে এবং সেনাবাহিনী সদর দফতরে জেনারেল স্টাফ করা হয়।
কেকে/এমএস