এত দিন ঘাপটি মেরে থাকলেও ধীরে ধীরে স্বরূপে ফিরতে শুরু করেছেন প্রশাসনে থাকা স্বৈরাচারের সহযোগীরা। তাদের কর্মকাণ্ডেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে তাদের মতাদর্শ। তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বিভিন্নভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করছে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত পতিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস অতিক্রান্ত হলেও এসব আওয়ামীপন্থী পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
তারা পুলিশ সদর দফতরসহ পুলিশের ৮টি ইউনিটে কর্মরত থেকে কৌশলে সরকারের গোপন তথ্য পলাতক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ফাঁস করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। আর এই তথ্য ফাঁসের কারণেই জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ভাটা পড়েছে। শুধু তাই নয়, পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা নানাভাবে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন তাদেরও সহযোগিতা করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
এদিকে জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত দুটি হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) রমনার পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আরিফ। অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকেও। তবে আদালতে ওঠার আগেই বিষয়টি ধরা পড়ে যায়।
নথিপত্র ও পুলিশ সূত্র বলছে, তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ তার ডিবির পরিচয় গোপন করে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক পরিচয় দিয়ে গত ২৩ অক্টোবর চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নেননি। বিষয়টি জানাজানির পর তিনি অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে চলে গেছেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ডিবি থেকে কোনো মামলায় অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য-স্মারকলিপিতে তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার, অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রশাসন), উপকমিশনার এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কমিশনার ও ক্ষেত্রবিশেষে কমিশনারের সই লাগে। কিন্তু জাহাঙ্গীর আরিফ কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর নেওয়া এড়াতে নিজেকে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক বলে উল্লেখ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফকে রোববার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে তাকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। ডিবি সূত্র বলছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জাহাঙ্গীর আরিফ দাবি করেছেন, তিনি অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিনের (এখন এপিবিএনে কর্মরত) নির্দেশে কাজটি করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এডিসি সানজিদা জানান, তিনি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। এ রকম আলোচিত মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের এখতিয়ার তার নেই।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানায় আটকে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত) দুই কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে ব্যাপক মারধরের ঘটনায় আলোচনায় এসেছিলেন এডিসি সানজিদা।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই শতাধিক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা আত্মগোপনে থাকলেও তাদের আস্থাভাজনরা আছেন প্রশাসনে। তারা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সেখান থেকে কৌশলে বাহিনীর গোপন তথ্য পলাতক কর্তাদের কাছে ফাঁস করছেন।
সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ সদর দফতরে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা রয়েছেন তথ্য ফাঁসকারী সিন্ডিকেটে। পুলিশ সদর দফতর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ওই সব কর্মকর্তারা শিকড় গেড়ে বসেছেন। পুলিশ সদর দফতরের পরেই আওয়ামীপন্থী সিন্ডিকেটের পুলিশ কর্মকর্তাদের শক্ত অবস্থান রয়েছে এসবি (স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ)। পুলিশের একমাত্র গোয়েন্দা সংস্থা এসবিতে ইমিগ্রেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন আওয়ামীপন্থী সিন্ডিকেটের পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা দেশের ইমিগ্রেশনসহ সীমান্ত এলাকা দিয়ে ছাত্র-জনতার হত্যার সঙ্গে জড়িত অনেককেই পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনাসহ বেশ কয়েকজন ডিসি ও এডিসি রয়েছেন যারা আওয়ামীপন্থী সিন্ডিকেটের পুলিশ কর্মকর্তারা। পলাতক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের সময় এদের ডিএমপিতে পদায়ন করা হলেও বর্তমান সরকারের সাড়ে চার মাস গেলেও এদের সড়ানো হয়নি। ফলে এরা ডিএমপি বর্তমান প্রশাসনের আস্থাভাজন হয়ে তথ্য ফাঁস করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট সারদা পুলিশ একাডেমি। যেখানে বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাসহ নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এসআইদের দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ওই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তারা রয়েছেন যারা সাবেক আইজিপি বেনজীর ও মনিরুল-হাবিব সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিল। যা ওপেন সিক্রেট। তারাও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এছাড়া নৌপুলিশ, সিআইডি, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, এটিইউ ও পিবিআইয়ের মতো পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে বহাল থেকে নানা কায়দায় তথ্য ফাঁস করছেন বেনজীর ও মনিরুল-হাবিব সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্যরা।
সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সিআইডিতে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলা রয়েছে। এছাড়া বিদেশে টাকা ও মানব পাচার, সোনা ও মাদক চোরাচালানসহ অতিগুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করা হয়। মোবাইল মনিটরিং ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট রয়েছে সিআইডিতে। একই সঙ্গে ব্যাংকের জালিয়াতিসহ আন্তর্জাতিক জালিয়াতি নিয়েও কাজ করে সংস্থাটি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় পতিত সরকারের সময় খুন-গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাও বহাল তবিয়তে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। যা এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
কেকে/এমএস