বাংলাদেশে গুমের ঘটনা নতুন নয়। আওয়ামী সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল-‘গুমের শিকার’ হওয়ার ঘটনা। এসব গুমে শিকার হতেন রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক, সংগঠক থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ নাগরিকও। এদিকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে আসলেও বেশিরভাগ লোকের অবস্থান এখনো অজানা।
অনেকের মতে- যারা এখনো ফিরে আসেননি তাদেরকে গুমের পর হত্যা করা হয়েছে। তাই দেশের পরিবর্তন হলেও তাদের ফিরে আসার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-গুমে হওয়ার পর যারা ফিরে আসছেন তাদের অনেকেই গুম হওয়ার ব্যাপারে মুখ খুলতে চান না।
অতিসম্প্রতি গুমের শিকার হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক খালেদ হাসান চারদিন পর উদ্ধার হয়েছেন। উদ্ধারের পর গুমের বিষয়ে তিনিও গণমাধ্যমে কোনো কিছু জানাননি। তবে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদের জানিয়েছেন- খালেদ হাসান ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। তিনি তার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাইলে সে তাকে তার গুম হওয়ার ঘটনা জানায়।
তিনি জানান, খালেদের ভাষ্যমতে- ‘শুক্রবার বিকালের দিকে টিএসসি থেকে রিকশায় করে দোয়েল চত্বরের দিকে যাবার সময় রিকশাতেই তিনি জ্ঞান হারান। পরবর্তীতে তিনি যখন জ্ঞান ফিরে পান নিজেকে সুনামগঞ্জের একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে মাইক্রোবাসে দেখতে পান। এ সময় তার সঙ্গে আরো ২-৩ জন ছিল। পরবর্তীতে তিনি ফের জ্ঞান হারান। দ্বিতীয়বার যখন খালেদ জ্ঞান ফিরে পান তখন নিজেকে পঞ্চগড়ের কোনো একটা জায়গায় দেখতে পান। তখনো মাইক্রোবাস চলমান ছিল। তৃতীয়বার মঙ্গলবার যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে, তখন তিনি নিজেকে বরিশালের এক রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেন। পরে তাকে কেউ একজন গাড়িতে তুলে দিলে ঢাকায় পৌঁছে হলে ফিরে আসেন। কাদের আরো বলেন, খালেদের মানসিক অবস্থা ভালো না। কাউকে কিছু বলতে পারছেন না।’
বাংলাদেশে গুমের ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যমতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৭২১ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছিলেন, যার মধ্যে ১৫৮ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। অপরদিকে আসকের তথ্যমতে, ২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬২৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে লাশ উদ্ধার হয়েছে ৭৮ জনের, অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৫৯ জনকে এবং পরে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৭৩ জনকে। বাকিদের এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এছাড়া মায়ের ডাক সংগঠনটির সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম আঁখি জানান, ‘গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো ১৫৩ জনের কোনো খোঁজ জানে না তাদের পরিবার।’
এর আগে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএসের তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণায় ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৭১ জনকে গুমের তথ্য উঠে এসেছে। এদের মধ্যে ২৩ জন ফিরে এলেও তারা নিখোঁজ থাকা অবস্থায় কোথায় কেমন ছিলেন, তা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, যে ৭১ জনকে গুমের অভিযোগ উঠেছে, তাদের মধ্যে ১১ জন করে আছেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী, ৮ জন শিক্ষার্থী, ইমাম, খতিব ও ধর্মীয় প্রচারক ৫ জন, ৩ জন সাংবাদিক, ২ জন করে আছেন বেসরকারি কর্মচারী, গাড়িচালক ও জুট মিলের শ্রমিক, একজন করে আছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র পরিচালক, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মাদ্রাসাশিক্ষক আছেন একজন করে। দেশের ১৮টি জেলায় এই গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬টি ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮টি ঘটেছে চট্টগ্রামে।
বিশ্লেষকদের মতে, গুমে শিকারদের নীরবতার পেছনে রয়েছে -ভয়, শঙ্কা, সামাজিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতা। ফেরত আসা ব্যক্তিরা অনেক সময় মনে করেন, তাদের যদি অতীতের ঘটনা নিয়ে কিছু বলা হয় তবে তাদের বা তাদের পরিবারের ওপর আসতে পারে নতুন কোনো বিপদ। এছাড়া গুমের পর তাদের ওপর নজরদারি ও বিভিন্ন ধরনের হুমকিও দেওয়া হয়ে থাকে; যা তাদেরকে চুপ থাকতে বাধ্য করে। তারা মনে করেন -আলোচনায় আসলে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন- এ নীরবতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এটি একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার ইস্যু। ফলে এর সমাধান প্রয়োজন বলেও তারা মনে করেন ।
কেকে/এমএস