রাজনৈতিক নানা মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে বছর শুরু হয় বিএনপির। জাতীয় নির্বাচন ‘ঠেকাতে’ না পারলেও দলের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ‘ভালোভাবেই’ সামাল দেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
দল এবং জোটের ঐক্য ধরে রেখে দেশের জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ‘সফলতা’ পান তিনি। ৭ জানুয়ারি ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। ফলে সরকার অস্বস্তিতে পড়ে। কিন্তু মামলা হামলা নির্যাতনে অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যায় দলটির নেতাকর্মীরা। আত্মগোপনে চলে যান কেন্দ্রীয় নেতারা; ঘরছাড়া হন তৃণমূল নেতাকর্মীরাও। নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা আঁটে বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিকদলগুলো। এমন প্রেক্ষাপটে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। বিএনপি কিছুটা দেখে শোনেই এগুচ্ছিল। কোটা আন্দোলনের শুরুতে ছাত্রদলের ব্যানারে নেতাকর্মীরা যোগ দিতে থাকে। কিন্তু দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে এ আন্দোলনকে অরাজনৈতিক করে তুলতে বিএনপির অংশগ্রহণে কৌশল পাল্টায়। জামায়াতে ইসলামীসহ সব রাজনৈতিক দলকে আওয়ামী সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন তিনি। রাজনীতিতে ব্যাকফুটে থাকা বিএনপি বছর শেষে চলে যায় ‘চালকের আসনে’।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন মাঠে আন্দোলনে থাকা বিএনপি ২০২৪ সাল শুরুর আগেই সরকারের রোশানলে পড়ে। প্রশাসনের গ্রেফতার অভিযানে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে মাঠ পর্যায়ের নেতকর্মীরা। অনেকটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়ান তারা। নির্বাচনের আগে অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে দলটি। বিএনপির সিনিয়র গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জেলে রেখে দ্বাদশ নির্বাচন তুলে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ভোটের আগে ও পরে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি বিএনপি। যদিও ভোট বর্জনের বার্তা নিয়ে জনগণের কাছে গিয়েছিল দলটি। ভোটের পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে পরিস্থিতি। একে একে কারামুক্ত হন নেতাকর্মীরা। শেখ হাসিনা সরকার সহজেই উপজেলা নির্বাচনের বৈতরণি পার হয়ে যায়। বহিষ্কার করেও দলীয় নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। রাজনীতির মাঠে একক নিয়ন্ত্রণ চলে আওয়ামী লীগের।
জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে। যেখানে বিএনপি ছাত্রদের ব্যানারে মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে দলটি ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। অবশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা। ৬ আগস্ট থেকেই রাজনীতির পটপরিবর্তন শুরু হয়। মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রাজনীতির মাঠ বিএনপির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। একে একে জেল থেকে মুক্তি পেতে থাকেন নেতাকর্মীরা। পল্টন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিশাল জমায়েতে বাধাহীন সমাবেশ করে দলটি। বড় প্রায় সব সমাবেশে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। মহানগর জেলা উপজেলা ও থানায় নতুন কমিটি দেয় দলটি। সরকারে না থাকলেও জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে বিএনপি সমর্থিত কর্মকর্তারা সামনে চলে আসেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিএনপিপন্থিরা সরব হয়ে ওঠেন।
৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি দলখদারি ভাঙচুর ও মামলা বাণিজ্যের বদনাম জুটে বিএনপির নামে। টাকার বিনিমিয়ে স্থানীয়ভাবে পতিত আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ ওঠে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। ভাবমূর্তি রক্ষায় কঠোর হয় বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিকবার হুঁশিয়ারিও দেন। কেন্দ্রীয়ভাবে ১ হাজার ৩১ নেতাকে বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১ হাজার ২০৩ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্ত থাকলেও এবার সরকার পতনের একদিন পর সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড মওকুফ করেন। মুক্তির পর গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে এ সংবর্ধনায় উপস্থিত হন খালেদা জিয়া।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। তিনি তখন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের কারাগারে ছিলেন। দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাহী ক্ষমতায় খালেদার দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। ওই বছরের ২৫ মার্চ সাময়িক মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফেরেন খালেদা জিয়া। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন। এরপর থেকে পরিবারের আবেদনে প্রতি ছয় মাস পরপর বিএনপি নেত্রীর মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে আসছিল শেখ হাসিনার সরকার। প্রতিবারই তাকে দুটি শর্ত দেওয়া হচ্ছিল। তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার আবেদন করা হলেও ওই শর্তের যুক্তি দিয়েই বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেছে শেখ হাসিনার সরকার। সবকিছু ঠিকঠিক থাকলে নতুন বছরের শুরুতেই উন্নত চিকিৎসায় লন্ডন যেতে পারেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামে ৩৭টি মামলা ছিল। ৫ আগস্টের পর বেশিরভাগ খারিজ হয়ে গেছে। সাজা বাতিল করা হয়। ছোটখাটো দুয়েকটি মামলা হয়তো আছে, যা গুরুতর কিছু নয়। উনি আইনগতভাবে সম্পূর্ণ মুক্ত।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, কোনো আন্দোলনই অরাজনৈতিক হয় না। এটা ভুল কথা। ফ্যাসিবাদ মুক্তির আন্দোলন গড়ে ওঠে গত ১৬ বছরে, প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এর চূড়ান্ত রূপ নেয় জুলাই-আগস্টে। ৫ আগস্ট চূড়ান্ত ফয়সালা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, নতুন বছরে এ আন্দোলন কতটা পরিপূর্ণতা দেয়া যাবে.... তা গণতন্ত্র, স্বাধীনতার পূর্ণতার মধ্যে দিয়ে দেওয়া সম্ভব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অবশ্যই একটা নির্বাচিত সরকারের দ্বারা সম্ভব। মানুষ খুবই কষ্টে আছে, বেকার যুবকদের কর্মসংস্কানের ব্যবস্থা, শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা কেবল নির্বাচিত সরকার দ্বারাই সম্ভব। মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে তাদের সেবার করার দায়িত্ব দেবে।
তিনি বলেন, গত চার মাসে আইনশৃঙ্খলা খুবই বাজে পরিস্তিতিতে নিয়ে গেছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন বছরে দেশে ফেরার আভাস পাওয়া গেছে। সপরিবারে ঢাকা ফিরে তিনি গুলশানে উঠবেন। ইতোমধ্যে তার থাকার জন্য ৩টি বাসাও দেখা হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলাগুলো মোকাবিলা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মানহানির মামলা খারিজ হয়েছে। এখনো ২৪টি মানহানির মামলা রয়েছে। এগুলো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া চারটি মামলায় তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত। সেগুলোরও শিগগিরই শুনানি হবে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে তার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে ফিরবেন, তা তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে তার দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই। এক-এগারো সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে মোট ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়। পরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২টি ক্রিমিনাল মামলাসহ মোট ৬৪টি মানহানির মামলা করা হয়। এর মধ্যে ৫টি মামলায় তাকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২১ আগস্টের মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। সব মিলিয়ে এখন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৪টি কনভিকশনের মামলা এবং ২৪টি মানহানির মামলা বিদ্যমান। এই মামলাগুলো আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করা যায় দ্রুতই এগুলো শেষ হয়ে যাবে।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান তিনি। তখন থেকেই তিনি লন্ডনে রয়েছেন।
কেকে/এমএস