শীত আমাদের দেশের প্রধান ঋতুগুলোর মধ্যে একটি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস হলো শীতের ভরা মৌসুম। এ মৌসুমে দুর্ভোগের অন্ত থাকে না, অনেকেই ঠান্ডাজনিত রোগসহ নানা রোগে ভোগেন। তবে এ দুর্ভোগ ধনীদের জন্য নয়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। বিশেষ করে পথশিশুদের জন্য। শীতকালে পথশিশুদের নিয়ে কী ভাবছেন তরুণেরা? এ বিষয়ে কথা হয় ছয় জন মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীর সাথে।
১. আসুন শীতে পথশিশুদের পাশে দাঁড়াই
পথশিশু নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে—পথশিশু কারা। পথশিশু বলতে বুঝায় সেইসব শিশুকে, যারা দারিদ্র্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত, গৃহহীনতার নির্মম অভিশাপে জর্জরিত, সামাজিক সুরক্ষার আওতা থেকে বঞ্চিত, শিক্ষার আলো থেকে বিচ্ছিন্ন এবং শারীরিক নিরাপত্তার সংকটে নগর কিংবা গ্রামের পথে পথে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ যেন মানবতার পরাজয়ের এক করুণ চিত্র। ফুটপাত, স্টেশন চত্বর কিংবা কোনো অন্ধকার অলিগলি হয়ে ওঠে তাদের বসবাসের জায়গা। পথশিশু শুধু একটি সামাজিক সংকট নয়; এটি আমাদের সভ্যতার ব্যর্থতার এক তীক্ষ্ণ উদাহরণ। তাদের জীবন যেন এক নিরন্তর অভিশাপ, যেখানে প্রতিটি শ্বাসই এক নতুন বেদনার সাক্ষ্য দেয়।
ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে ৬,০০,০০০-এর বেশি পথশিশু বসবাস করছে এবং এদের ৭৫%ই রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে। মানব উন্নয়ন সূচকে ১৩৮তম স্থানে থাকা একটি দেশ, যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সেখানে এই শিশুরা সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে।
শীতকাল এইসব পথশিশুদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম। শীতকালে পথশিশুদের কষ্ট অসহ্য হয়। যখন আমরা গরম কম্বলের নিচে আরামে ঘুমাই, তখন তারা হিমশীতল রাতে কাঁপতে থাকে। তাদের কাছে গরম কাপড় বা খাবারের মতো সামান্য জিনিসও অনেক বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
পথশিশুরা এত কষ্ট পায় কারণ- তাদের নিজস্ব কোনো ঘরবাড়ি নেই। ফলে তারা রাস্তায়, ফুটপাতে বা অন্য কোথাও শুতে বাধ্য হয়। তাদের কাছে গরম কাপড় কেনার মতো অর্থ নেই। প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতেই তাদের কষ্ট হয়। অসুস্থ হলে তারা যথাযথ চিকিৎসা পায় না। তারা স্কুলে যেতে পারে না, ফলে ভবিষ্যতে তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। আসুন আমরা সবাই তাদের পাশে দাড়াই। গরম কাপড়, খাবার, ওষুধ ইত্যাদি দান করে তাদের সাহায্য করি, অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো পথশিশুদের জন্য কাজ করে। তাদের সাহায্য করে পথশিশুদের পাশে দাড়াই। একটি শিশুর জীবন বদলে দিতে আপনার একটু সাহায্যই যথেষ্ট।
আসুন, সবাই মিলে পথশিশুদের জন্য কাজ করি। তাদের সুন্দর জীবন উপভোগ করতে সাহায্য করি।
তাকিয়া তাহসিনা তিমু
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
২. মানবিক উদ্যোগ প্রয়োজন
যখনই বাংলাদেশে শীতের মৌসুম চলে আসে তখন তীব্র শৈত্য প্রবাহের কারণে পথশিশুদের জীবনযাপন থাকে হুমকির মুখে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের আর্থিকভাবে সচ্ছল প্রতিটি নাগরিক যদি পথশিশুদের মাঝে সাহায্যের হাত বাড়ায় তাহলে তীব্র শীতের কারণে পথশিশুদের অসহায়ত্বের চিৎকার কিছুটা হলেও বন্ধ করা যাবে। বিশেষ কোনো দিবসে পথশিশুদের মাঝে এক বেলার খাবার বিতরণ করলেই সাহায্যের হাত বাড়ানো সম্পূর্ণ হবে না, সাহায্যের হাত সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন তাদের সুন্দর ও সুশৃংখলভাবে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে যেসব পরিস্থিতি বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেইসব পরিস্থিতি উপযুক্ত উপাদানের মাধ্যমে মোকাবেলা করা এবং সঠিক নিরাময় প্রদান।
তীব্র শীতের নির্মমতায় পথশিশুদের কষ্ট কমাতে আমাদের প্রত্যেকেরই মানবিক উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পুরাতন পোশাক সংগ্রহ করে পথশিশুদের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে।
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের শিশুদের পুরাতন জামাকাপড় দিয়ে সাহায্য করতে পারে। যাদের শিশু নেই, তারা আয়ের একাংশ দিয়ে শীতবস্ত্র, খাবার, ওষুধ কিনে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন।
উচ্চবিত্তরা চাইলে একটি পথশিশুর মৌলিক চাহিদা—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা—পূরণের দায়িত্ব নিতে পারে। এতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পথশিশুর সংখ্যা কমবে এবং সমাজে মানবিকতার আলো ছড়াবে। একসঙ্গে এগিয়ে এলে এই শীত কেবল সহনীয় নয়, স্নেহময়ও হয়ে উঠবে।
ফিদাউর রহমান নূর
শিক্ষার্থী, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
৩. পথশিশুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন জরুরি
শীতকাল বাংলাদেশের জন্য একটি আনন্দদায়ক ঋতু হলেও পথশিশুদের জন্য এটি কঠিন বাস্তবতার নাম। শীতের হিমেল বাতাস আর নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। ফুটপাত, রেলস্টেশন, কিংবা খোলা আকাশের নিচে তাদের ঠাঁই। গরম কাপড়ের অভাব, পর্যাপ্ত খাবার এবং চিকিৎসার সুযোগের অপ্রতুলতা তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে।
পথশিশুরা রাস্তায় বসবাস করে, যেখানে নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়। খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা বা মৌলিক মানবাধিকার— কোনোটাই তাদের জন্য সহজলভ্য নয়। অধিকাংশ সময় তারা ক্ষুধার্ত, অপুষ্টিতে ভোগে এবং নানান ঝুঁকিতে দিন কাটায়। নিরক্ষরতার কারণে তারা কোনো পেশাগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে না, ফলে ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। অপরাধপ্রবণ পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে অনেক সময় তারা মাদক, চুরি বা মানব পাচারের শিকার হয়।
সমাজের অবহেলিত এই শিশুদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের মানবিক দায়িত্ব। পথশিশুদের কষ্ট লাঘবে প্রথমেই প্রয়োজন শীতবস্ত্র বিতরণ। পুরোনো সোয়েটার, কম্বল, কিংবা গরম কাপড় সমাজের বিত্তবান ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো তাদের মাঝে বিতরণ করতে পারে। প্রশাসন ও এনজিওগুলোর যৌথ উদ্যোগে অস্থায়ী শেল্টার এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে তারা আশ্রয়, খাবার, এবং চিকিৎসাসেবা পাবে।
তবে কেবল শীতকালে সহায়তা নয়, পথশিশুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন জরুরি। শিক্ষার সুযোগ এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। সমাজের প্রতিটি শ্রেণি যদি তাদের প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্বশীলতার হাত বাড়ায়, তবে একদিন এই শিশুরাও দেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে পারবে।
পথশিশুরা আমাদেরই সমাজের অংশ। তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি কেবল শীত নয়, সারাবছরই তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে। আসুন, শীতের এই দিনে তাদের জন্য উষ্ণতার বার্তা পৌঁছে দিই।
নবনিতা দাস রাখি
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
৪. নিরাপদ ও উষ্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করি
বাংলাদেশের শীতকাল প্রকৃতির এক অনন্য রূপ উপহার দিলেও পথশিশুদের জন্য এটি বয়ে আনে চরম দুর্ভোগ। বাংলাদেশে আনুমানিক ১০ লাখের উর্ধ্বে পথশিশু রয়েছে, যাদের অধিকাংশই রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বসবাস করে। এসব শিশুদের বেশিরভাগই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়, যেখানে শীতের তীব্রতায় তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে ঠাণ্ডাজনিত রোগ যেমন নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি ও ত্বকের নানা ধরনের সমস্যায় তারা সহজেই আক্রান্ত হয়।
এই সংকট নিরসনে কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও বিতরণের উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে জনসাধারণের মধ্যে শীতবস্ত্র ও আর্থিক সহায়তার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পথশিশুদের জন্য রাতযাপনের নিরাপদ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া, মোবাইল মেডিকেল টিমের মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং খাদ্য বিতরণের কার্যক্রম চালু করা দরকার।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র ও উপযুক্ত শিক্ষা কর্মসূচি গড়ে তুলতে হবে, যাতে এসব শিশুদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি পথশিশুদের দুরবস্থা সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানো দরকার। শুধু সরকার নয়, সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ করে, দান করে বা সচেতনতা সৃষ্টি করে এই শিশুদের পাশে দাঁড়াতে পারি। তাই আসুন মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে পথশিশুদের শীতের কষ্ট দূর করতে এগিয়ে আসি এবং তাদের জন্য একটি নিরাপদ ও উষ্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করি।
মেহেদী হাসান শুভ
শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকার এবং নগর উন্নয়ন বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
৫. কারো পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ
বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু, নানান রূপে আবির্ভাব ঘটে তাদের। সবার রূপ, রস, সৌন্দর্য্য ভিন্ন ভিন্ন। একেক ঋতুর প্রকাশ যেমন ভিন্ন, সেভাবেই মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও ভিন্ন। অন্যান্য ঋতুর গ্রহণযোগ্যতার মাঝে খুব বেশি পার্থক্য না থাকলেও শীতকে যেন মানুষ গ্রহণ করে নানারুপে, নানাভাবে।
একদিকে শীতে যেমন একশ্রেণির মানুষের মাঝে পড়ে পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম, সাথে লেপ কাঁথা মুড়িয়ে রাতের উষ্ণতা অনুভব; তেমনি আরেক শ্রেণি শীতকে গ্রহণ করতেই যেন অনিচ্ছুক। কারণ শীতের নিদারুণ কষ্ট তাদের ভুগিয়ে যায় পুরো শীতকাল জুড়ে। ‘কারোর পৌষ মাস তো কারোর সর্বনাশ’- প্রবাদটি হয়তো এজন্যই প্রচলিত হয়েছিল। এই সময় অন্যতম ভোগান্তি শুরু হয়ে যায় পথশিশুদের।
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী- বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু, তন্মধ্যে ১৫ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অন্য এক গবেষণা বলে, এই পথশিশুদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ শিশুর কোনো শীতবস্ত্র নেই। শীতের ভয়াবহতা লেপ-কাঁথা মুড়িয়েও নিবারণ কর সম্ভব হয় না অনেক সময়। কিন্তু এই পথশিশুরা শীতবস্ত্র তো পায়ই না, রাতে সামান্য আশ্রয় টুকু নিয়েও থাকে সংশয়ে। রাতে শরীর হিম করা ঠান্ডায় তারা কখনো গায়ে মুড়িয়ে নেয় পথে পড়ে থাকা কাগজ, পলিথিন। আবার কখনো কুকুর বিড়ালের মতো পশুদের গায়ের ওম জড়িয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে। কোথাও আশ্রয় নিয়েও তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না, এই বুঝি তাড়িয়ে দেয়। কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে খোলা আকাশের নিচে কাটানো তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে অধিকাংশ সময়। দোকানের টং, রাস্তার ধার কিংবা উন্মুক্ত কিছু পার্কের বেঞ্চের হিম ঠান্ডায় শরীরে ক্লান্তি নিয়ে ঢুলে পড়তে হয় তাদের।
দেশের উত্তরবঙ্গের দিকে তাকালে চোখে পড়ে আরও ভয়াবহ চিত্র। হিমালয়ের সন্নিকটে হওয়ায় তাপমাত্রা অনেক কমে আসে উত্তরবঙ্গে। এই সময় শীতের কবলে মৃত্যুর সংবাদ কানে আসে অহরহ। পথশিশুরা বস্ত্রের অভাবে শরীর গরম করতে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিয়ে বাঁচতে চায়। এ সময়ে আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর সংবাদও কম নয়। বস্ত্র ছাড়াও খাদ্যের অভাবে ডাস্টবিন থেকে পড়ে থাকা অস্বাস্থ্যকর পঁচা ঠান্ডা খাবার খেয়েও পড়ে যায় অসুখের কবলে। তাদের শরীর খারাপ, সর্দি-জ্বর কিংবা নিউমোনিয়া নিয়ে ভাবার মতো কেউ নেই। অসুখে পড়ে মৃত্যু তো তাদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু সমাজের কিছু সুশীল মানুষের সামান্য সাহায্য এবং সচেতনতায় পারে এই অবহেলিত পথশিশুদের নিদারুণ কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিনিয়ত কাজ করে গেলেও এই বিপুল সংখ্যক পথশিশুর সবার জন্য বস্ত্র, বাসস্থানের সমস্যা মেটানো সম্ভব হয় না। এজন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, সরকারি উদ্যোগ এবং উচ্চ শ্রেণির মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা।
সাদিয়া ইসলাম জেমি
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
৬. মানবিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন
বাংলাদেশের শীতকাল পথশিশুদের জন্য এক নিঃশব্দ আর্তনাদ। দেশের পথশিশুর অধিকাংশই শীতের সময় খাদ্য, পোশাক, ও আশ্রয়ের অভাবে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম করে।
রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের স্টেশন, প্রতিটি কোণায় দেখা মেলে পথশিশুর। খালি পায়ে ময়লা চাদর জড়ানো এ শিশুরা যেন শীতের তীব্রতায় মাটির সাথে মিশে যায়। তারা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নতুন দিনের অপেক্ষা করে, কিন্তু তাদের সেই দিন কি আদৌ আসে? এদের বেশিরভাগই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী শহরে বসবাস করে। শীতজনিত রোগ যেমন নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং সর্দি-কাশি তাদের জীবনের সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কাজ করছে। যেমন- আপন ফাউন্ডেশন, ড্রিম ফর ডিসঅ্যাডভান্টেজড চিলড্রেন (DDC), ব্রাক, সারা বাংলা, আশা, পথশিশু কল্যাণ ফাউন্ডেশন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় পথশিশুদের জন্য খাবার ও শীতবস্ত্র সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া বিডি ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশন ও নগর ফাউন্ডেশন পথশিশুদের শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবায় ভূমিকা রাখছে। তবে এসব উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী এবং স্থানীয় সীমাবদ্ধতার কারণে সার্বিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়।
প্রশাসনের ভূমিকা এই সংকট নিরসনে অপরিহার্য। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে পথশিশুদের জন্য অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা, যেখানে তাদের জন্য শীতবস্ত্র, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাদ্যের সরবরাহ থাকবে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও বিতরণ কর্যক্রম পরিচালনা। বিশেষ করে, জনসাধারণের মধ্যে শীতবস্ত্র ও আর্থিক সহায়তার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা প্রয়োজন। অনলাইনে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সাহায্যের কথা বলা, মিডিয়ায় পথশিশুদের করুণ বাস্তবতা তুলে ধরা, পথশিশুদের অবস্থান চিহ্নিত করে মনিটরিং টিমের মাধ্যমে সার্বিক কাজ পরিচালনা করা। মোবাইল মেডিকেল টিমের মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং খাদ্য বিতরণের কার্যক্রম চালু করা।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র ও উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গড়ে তোলা, যাতে এসব শিশুদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। শুধু সরকার নয় ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় এনজিওদের সাথে যৌথভাবে কাজ করাও হতে পারে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ।
আমাদের খাবার টেবিলে এক বেলা কম খরচ করলেই হয়তো একটি শিশুর জন্য উষ্ণ কম্বল কেনা সম্ভব। আসুন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ শীতকে মানবতার উষ্ণতায় ভরিয়ে তুলি।
ফায়জুন্নাহার শান্তা
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কেকে/এমআই