সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কিছু শীর্ষ ব্যবসায়ী দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বিদেশে স্থায়ী হচ্ছেন। এতে দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে অর্থপাচার ও বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ প্রতিষ্ঠার প্রবণতা এ সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে ২৬০৬ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এ তালিকায় রয়েছেন দেশের বিভিন্ন দলের রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা ও প্রভাবশালীদের বড় একটি অংশ। তারা দেশের অর্থ লোপাট করে বিদেশে গেড়েছেন শক্ত খুঁটি। সেখানে গড়েছেন অঢেল সম্পদের পাহাড়।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর নাগরিকত্ব ত্যাগ করার বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান ও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রুপের মালিকদের নাম। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে রয়েছে দেশের কোটি কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ। ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষ ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তে যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত দল গঠন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ টিম আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের অধীনে কাজ করবে। এনবিআরের তালিকায় অভিযুক্ত গ্রুপগুলো হলো এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, সিকদার ও আরামিট গ্রুপ। এনবিআরের আয়কর বিভাগের ১০ জন কর পরিদর্শক এবং কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের ১০ জন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা কর ফাঁকি, অর্থ পাচার এবং মানিলন্ডারিং আইনের অধীন অপরাধগুলো তদন্ত করবেন বলে জানা গেছে।
তথ্য বলছে, অর্থ পাচারের অভিযুক্ত মুহাম্মদ আজিজ খান সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করছেন এবং ২০১৬ সালে সামিটের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুরে স্থানান্তর করেন। অপরদিকে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবার ২০২২ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। তারা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমোদন পেয়েছেন, যা নাগরিকত্ব ত্যাগের পর বিদেশি নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
তথ্য বলছে-২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৬০৬ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। ২০১৭ সালে ১১৯ জন, ২০১৮ সালে ৩৬৫ জন, ২০১৯ সালে ৩৫৬ জন, ২০২০ সালে ৩২৩ জন, ২০২১ সালে ১৬৫ জন, ২০২২ সালে ৪২১ জন, ২০২৩ সালে ৫৪৮ জন এবং ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০৯ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দেশ জার্মানির নাগরিকত্ব নেওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এর পরে আছে জার্মানিরই প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় বিভক্ত হওয়ার পর নাগরিকত্ব পরিত্যাগের তথ্য হারিয়ে যায়। ফলে ২০১৭ সালের আগে কতজন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন, সে তথ্য সুরক্ষা সেবা বিভাগে নেই। তাদের ধারণা, ২০১৭ সালের আগে সংখ্যাটি এখনকার তুলনায় বেশ কম ছিল। তথ্য বলছে, গত আট বছরে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ৪০টির বেশি দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশিরা। গত আট বছরে ১ হাজার ২৮১ জন বাংলাদেশি জার্মানির, ৩৯২ জন অস্ট্রিয়ার, ১৮০ জন সিঙ্গাপুর, ১৫১ জন ভারত, ৬০ জন কোরিয়া, ৫৭ জন নরওয়ে, ২৫ জন যুক্তরাজ্য, ১৭ জন ইউক্রেন, ১৫ জন শ্রীলঙ্কা, ১৩ জন করে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরান; ১১ জন ইন্দোনেশিয়া ও ৯ জন বুলগেরিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া পাকিস্তান ও মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়েছেন ৪ জন।
এদিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক দুর্নীতিবাজ ও নব্য ধনীর বিদেশে অর্থ পাচারের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের বিদেশে পাড়ি জমানোর কথা জানা যায়। ওই সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশিদের আরও বেশি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশিদের নতুন করে আরও ৪৪টি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ করে দেয় মন্ত্রিসভা। এর আগে ৫৭টি দেশের নাগরিকেরা এ সুযোগ পেতেন। কয়েকটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কর্ণধাররা নিজে কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বা দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী বলে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। কোনো কোনো দেশের পাসপোর্ট পাওয়ার শর্ত হিসেবে আগের দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। আবার কোনো কোনো দেশের পাসপোর্ট পাওয়ার পর নাগরিক হিসেবে শপথ নিতে হলে আগের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। এ জন্য উল্লিখিত বাংলাদেশিরা নাগরিকত্ব ছেড়েছেন বলেও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নাগরিকত্ব ত্যাগ ও অর্থপাচার দেশের অর্থনীতি ও সুশাসনের জন্য গুরুতর হুমকি স্বরূপ। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি, যাতে দেশের সম্পদ ও মানবসম্পদ বিদেশে পাচার রোধ করা যায় ও দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যারা নাগরিকত্ব ত্যাগ করছেন, তাদের জন্য দায়বদ্ধতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনৈতিক বা সামাজিক সুবিধা গ্রহণ করে বিদেশে চলে যাওয়া কোনোভাবেই নৈতিক নয়।
কেকে/এমএস