গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই থেকে কাছের দূরের বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা ড. ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে নোবেলজয়ীসহ বিশ্বনন্দিত নানা অঙ্গনের মানুষজনও তাকে শুভেচ্ছায় ভাসাচ্ছেন।
কূটনীতির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন বিন্যাস। ভারতনির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই পাকিস্তানের পণ্য আমদানিতে গুরুত্ব দিয়েছে, একের পর এক পাকিস্তানি জাহাজ বাংলাদেশে পণ্য নিয়ে আসছে। আবার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়টিতে।
জাতিসংঘ সম্মেলনে ইউনূস চমক ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সফরে তিনি বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে তিনি বৈঠকও করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সাইডলাইনে ৪০টি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেন।
নানা কারণে প্রধান উপদেষ্টার এ সফরটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের এক ধরনের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল। এ সফরে সেই সংকট অনেকটাই কেটেছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সংকট ছিল, এই সফরে সেটা কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় সফরেও আলো ছড়িয়েছেন ড. ইউনূস আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনে আলো ছড়িয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে ভাষণ দেন তিনি। এছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে এলডিসি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। এ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাও ছিলেন। পরের দিন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাকুতে কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলন কেন্দ্রে এ সাক্ষাতে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন তারা।
এর আগে গত ১২ নভেম্বর জলবায়ু সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-আড্ডো, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার প্রেসিডেন্ট ডেনিস বেচিরোভিচ সাক্ষাৎ করেন।
এছাড়া বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলি, আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইদি রামা, লিখটেনস্টাইনের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিয়েল রিশ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে ও ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট শিনা আনসারির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন ড. ইউনূস।
গত ৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে অবস্থানরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯ দেশের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় আসেন ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে। ড. ইউনূস রাষ্ট্রদূতদের তাদের ভিসা সেন্টার দিল্লির পরিবর্তে ঢাকা অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তর করার আহ্বান জানান।
তিনি জানান, ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করায় অনেক শিক্ষার্থী দিল্লি গিয়ে ইউরোপের ভিসা নিতে পারছেন না। ফলে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলাদেশের শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। ফলে তাদেরও এ বিষয়ে একটা উদ্বেগ আছে।
গত ৯ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পূর্ব নির্ধারিত এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ইইউর ১৯ রাষ্ট্রদূতের দলটির নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন মাইকেল মিলার। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে ১৫ জন রাষ্ট্রদূত তাদের মতামত তুলে ধরেন।
বৈঠকে শ্রম অধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ডিসেম্বর মাসে গোটা মাসজুড়ে আমরা বিজয় উদযাপন করি। বিজয়ের মাসে আপনাদের সঙ্গে এমন একটি ইন্টার-অ্যাক্টিভ আলোচনায় অংশ নিতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।’
এসময় জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর গত ১৬ বছর ধরে অত্যাচার, শোষণ, বলপূর্বক গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের বিষয় উল্লেখ করে দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং ব্যাংকিং সিস্টেমকে কীভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছিল সেসব কথা জানান। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক আকারে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এই মিস-ইনফরমেশন ঠেকাতে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা যে টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে তা দিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি।
সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা আজকের বৈঠকে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও ইইউ প্রতিনিধিদের বিশদভাবে জানান অধ্যাপক ইউনূস।
বৈঠকে উপস্থিত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, ইতোমধ্যে বুলগেরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে। তিনি অন্য দেশগুলোকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণের আহ্বান জানান। বৈঠকে ইইউর রাষ্ট্রদূতরা সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। কিছু পরামর্শ ও সুপারিশ তুলে ধরে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন তারা।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠকে ভারত থেকে ভিসা সেন্টার সরিয়ে নেওয়ার জন্য স্পষ্টভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। কারণ, এ মুহূর্তে যারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতে চাচ্ছেন তারা ভারতীয় ভিসা জটিলতার কারণে যেতে পারছেন না। অনেক সময় এ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বেশ বিলম্বিত হচ্ছে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে সে বিষয়েও তাদের বলা হয়েছে। আমরা বলেছি, বিভিন্ন জায়গায় যেসব অপপ্রচার চলছে সেগুলো প্রতিরোধ করে জাতীয় ঐক্য করার প্রচেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে জুলাই বিপ্লব কী এবং সেটিকে ঘিরে কেমন আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে সে বিষয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জানানো হয়েছে।
সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তুরস্কের ফার্স্টলেডি ইমিনে এরদোয়ান। এছাড়া জো বাইডেন থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধানরা তাকে শুভেচ্ছা জানান।
এছাড়া শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন ৯২ নোবেলজয়ীসহ ১৯৮ বিশ্বনেতা। একইসঙ্গে সদ্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ড. ইউনূসসহ অনেকে নির্যাতিত হয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
যারা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন, তাদের মধ্যে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, শান্তিতে নোবেলজয়ী নাদিয়া মুরাদ ও শিরিন এবাদি; নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গ্রো ব্রুন্ডল্যান্ড, রোমানিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এমিল কনস্টান্টিনেস্কু, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাটস কার্লসন, ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন, মার্কিন রাজনীতিক টেড কেনেডি জুনিয়র রয়েছেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকে আছে আগের মতোই। বরং আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের পুরো এলাকায় জান্তাদের হটানোর পর আরো জটিল পরিস্থিতি। চিনও সেভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা করতে পারছে না।
কেকে/এমএস