গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরের পৌরসভার সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান। প্রায় দুই যুগ ধরে পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে অনেকটা ‘শূন্য’ থেকে বর্তমানে পাহাড়সম সম্পদের মালিক হয়েছেন এলাকায় ‘দরবেশ’ খ্যাত এই মুজিবর।
তার এত সম্পদের উৎস নিয়ে স্থানীয়রা প্রশ্ন তোলেছেন। মজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে সখ্যতা। এতই সখ্যতা ছিলে যার কারণে স্থানীয়রা তাকে মন্ত্রীর ছেলে হিসিবেও আখ্যায়িত করেছেন। তবে মজিবুর দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ‘একটা চক্র তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ থাকাকালীন মোজাম্মেলের পা চেটে কালিয়াকৈরবাসীকে জিম্মি করে রেখেছিল এই মজিবুর। গত ১৫ বছর অওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপি নেতারা অনেক নির্যাতিত হলেও বিএনপিপন্থি মজিবুরের ক্ষেত্রে পুরোটাই ছিল উল্টো চিত্র। পৌরসভায় সরকারি বরাদ্দ আসলেও রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ইত্যাদি কোনো কাজ না করে হয়ে গেছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। এর অধিকাংশ টাকা খাটিয়েছেন জায়গার ব্যবসাতে, যা কালিয়াকৈরের সবাই অবগত আছেন। গত ১৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সারা দেশের পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করে। কিন্তু মেয়র মজিবুর সেটিকে না মেনে ২১ আগস্টে গাজীপুরের চন্দ্রাতে কিছু মানুষকে টাকা দিয়ে ভাড়া করে তার মেয়র পদ পুনর্বহাল চান। এমনকি কালিয়াকৈরের কিছু ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়েও আন্দোলনে নামান। কিছু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও জোরপূর্বক আন্দোলনে নামান, যা ভিডিওতে সবাই দেখেছেন; সেখানে ছোট বাচ্চাদের দিয়ে মুখস্থ করিয়ে তার নামে স্লোগান দেওয়ান। তিনি ২১ আগস্টে পুনর্বহাল আন্দোলেনের নামে ঢাকা টাঙ্গাইল হাইওয়েতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাড়ি আটকিয়ে জনসাধারণকে হয়রানিও করেছেন।
অভিযোগে আছে, মজিবুরে গুন্ডাবাহিনীর একটা সিন্ডিকেট আছে। এ বাহিনী দিয়ে একটি জায়গা দখলের পায়তারা করত। পরে জায়গার মালিক মজিবুরের সাহায্য নিতে গেলে মজিবুর সেগুলো সেটেলমেন্ট করত। জায়গার দাম ১০ কোটি থাকলে মজিবুর জায়গার মালিককে বলত ৩ কোটি দিতে। এরকম উদাহরণ অনেক আছে যা শফিপুর চন্দ্রার মানুষ সবাই অবগত বলেও জানান এক ভুক্তভোগী।
এদিকে এসব অভিযোগের ভিত্তিতে মজিবুর রহমান, স্ত্রী-সন্তান ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মজিবুর রহমানকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী ৫ জানুয়ারি সকাল ১০টায় তার স্থাবর সম্পদের ইনকাম ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ সব কাগজপত্র নিয়ে তাকে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক আলমগীর হোসেনের স্বাক্ষরিত চিঠি সাবেক মেয়র বরাবর আসে।
দুদকের দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কালিয়াকৈর পৌরসভার সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তার নিজের নামে, স্ত্রী সন্তান, ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নামে, বাড়ি, দোকানপাট, মার্কেট, জমি, প্লট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। এসব সম্পদের উৎস কোথায় তার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য বর্ণিত অভিযোগ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, অভিযোগ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার লক্ষ্যে আগামী ৫ জানুয়ারি সকাল ১০টায় দুদক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকায় হাজির হতে হবে। নির্ধারিত সময়ে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হলে বর্ণিত অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য নেই মর্মে গণ্য করা হবে।
অভিযোগ আছে, পৌরসভায় একক টেন্ডার বাণিজ্য, ভুয়া ড্রেনেজ ব্যবস্থার নামে প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি টাকা লোপাট, পৌরসভায় জনবল নিয়োগে অনিয়ম, পৌর এলাকায় অনিয়মিতান্ত্রিকভাবে পরিবহন খাত থেকে টোল আদায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি জবর দখল থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। এছাড়াও ক্ষমতার অপব্যহার করে সাধারণ মানুষের জায়গা জবর দখল, খাস ও বনের জমি জবর দখল করে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে মেয়র মজিবুরের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়রা বলছেন, মজিবুর রহমান মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় এমন দৃশ্যমান উন্নয়ন করেননি। নিজে আধিপত্য বিস্তার করে নামে বেনামে হয়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। তিনি এখন এখানকার অঘোষিত সম্রাট। পৌরবাসী অনেকটা জিম্মি দশায় রয়েছে তার কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেয়র মুজিবর রহমান এক সময় পরিবহনের ব্যবসা করতেন। এ ব্যবসায় তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেননি তিনি। পরে পরিবহন ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে শুরু করেন শেয়ারহোল্ডারে মুরগীর ব্যবসা। মুরগীর ব্যবসাতেও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হন তিনি। এসব ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জমি ঠিকাদারি পেশায়ও তেমন সফলতা ধরা দেয়নি তার কাছে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েন তিনি। এসব ব্যর্থতা নিয়ে অনেকটা বেকার ছিলেন তিনি। তার পিতা শুক্কুর আলী ছিলেন একজন কৃষক, পারিবারিকভাবে তেমন আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে ও বিএনপির এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা তানভীর ছিদ্দিকীর আশীর্বাদ পৃষ্ঠ হয়ে কালিয়াকৈর পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় যেন তার হাতে আলাদিনের চেরাগের দেখা মেলে। এরপর আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি।
২০০৪ সালে জোট সরকারের আমলে বিএনপি নেতা হওয়ার সেই সুযোগে কালিয়াকৈরের পৌর প্রশাসক নিয়োগ পান তিনি। পৌর প্রশাসক নিয়োগ পাওয়ার পরে ভবঘুরে মজিবুরের একক আধিপত্য বিস্তার ও পৌরসভার সব কাজ চলে আসে তার নিয়ন্ত্রণে। এরপরে হুহু করে বাড়তে থাকে সম্পদের পরিমাণ। পৌরসভার সকল উন্নয়নমূলক কাজ তার নিজস্ব ঠিকাদার দিয়ে করিয়ে সরকারি কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন। পৌরসভার এ পদটি যেন ছিল তার জন্য আলাদিনের চেরাগ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০০১ সালে কালিয়াকৈর পৌরসভাটি গঠিত হলেও মামলা জটিলতার কারণে সকল কর্মকাণ্ড স্থগিত থাকে। ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের সময় প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী তানভীর সিদ্দিকীর হাত ধরে কালিয়াকৈরের পৌর প্রশাসক হন মুজিবুর রহমান। পৌর প্রশাসকের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজে ধরে রাখতে নিজের লোক দিয়ে ফের নির্বাচন স্থগিত করে রাখতে নির্বাচনি এলাকার সীমানা জটিলতা দেখিয়ে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় পৌরসভার নির্বাচন দীর্ঘদিন বন্ধ রেখে নিজের একক আধিপত্য বিস্তার ধরে দুই হাতে কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার পৌরসভার যাবতীয় কাজ। ২০১১ ও ২০২২ সালে তিনি টানা দুইবার নির্বাচনে বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন। দীর্ঘদীন একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে পৌর এলাকায় একক ছত্রছায়ায় নামে বেনামে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। তার এসব কেনা জমি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। সরকারি বনের জায়গা দখল করে পরবর্তীতে সে জমি শিল্পকারখানার মালিকের কাছে জবর দখল বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কালিয়াকৈর পৌরসভার বক্তারপুর এলাকায় সরকারি বনের জায়গার ভিতরে মেয়রের রয়েছে ২৫০ শতাংশ জমি। একই এলাকায় কালামপুর মডেল পাবলিক স্কুল সংলগ্ন রেললাইনের পাশে রয়েছে ১১০ শতাংশ জমি। এছাড়া পৌরসভার জমিদারবাড়ীর পাশে শ্রীফলতলী ইউনিয়ন পরিষদের পশ্চিম পাশে এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে শ্রীফলতলী মৌজায় মেয়রের আস্থাভাজন মো. আকরাম আলী গংয়ের নামে ১৭৪ জমি রয়েছে মেয়রের। যার এস.এ নং-১১, আর.এস নং- ২৩০, এস.এ নং-২০ ও আর.এস নং-৮১। পৌরসভার ছোট লতিফপুর সোহেল মিয়ার বিল্ডিংয়ের সঙ্গে রয়েছে ১৫০ শতাংশ জমি, একই এলাকায় লতিফপুর বাগানবাড়ীর সঙ্গে রয়েছে তার ১৫০ শতাংশ জমি, পৌরসভার কালিয়াকৈর বাজার সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে ৪ তলা ভবন, কালিয়াকৈর বাজার মেইন রোডের সঙ্গে রাবেয়া সখিনা ক্লিনিকের সঙ্গে লাগোয়া ৫ তলা ভবন এবং হাসপাতালের পেছনে রয়েছে ৫৫ শতাংশ জমি। এছাড়া কালিয়াকৈর পৌরসভার রেললাইনের সঙ্গে লাগোয়া ৩৫০ শতাংশ জমি রয়েছে মেয়র মজিবুর রহমানের।
কালিয়াকৈর পৌরসভার সফিপুর বাজার সংলগ্ন কৃষি ব্যাংকের উত্তর পাশে ৬ তলা ভবন রয়েছে মজিবুরের। পৌরসভার চন্দ্রা হরিণহাটি জামে মসজিদের পূর্ব পাশে রয়েছে ৭ তলা ভবন এবং এ মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া ৫ তলা ভবন। এছাড়া চন্দ্রা সাভার-টাঙ্গাইল বাইপাসের সঙ্গে রয়েছে ১৫০ শতাংশ জমি। চন্দ্রা পল্লী বিদ্যুৎ লিভাটী ফ্যাক্টরির সঙ্গে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ৫ তলা ডুপ্লেক্স বাড়ি। যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি টাকার উপরে। এছাড়াও নিজের স্ত্রী আজমেরী বেগমের নামে বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশত একর জমি কিনেছেন তিনি। শুধু তাই নয় তার অধিকাংশ সম্পদ নিজের নামে নয়, কিনেছেন স্ত্রীর নামে। এমনকি তার বাড়ির কাজের লোকের নামে জমি কিনেছেন বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।
এছাড়াও মজিবুর রহমানের কালিয়াকৈর পৌরসভার লতিফপুরের থানার পাশে এস.টি টাওয়ার নামের ১১ তলা বিশিষ্ট ভবনের কাজ চলমান রয়েছে।
অনিয়ম এবং অভিযোগ প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে মুজিবর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, ‘আমি মেয়র ছিলাম উনি (আ ক ম মোজাম্মেল হক) এমপি-মন্ত্রী ছিলেন। কাজের ব্যাপারে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কাজের ব্যাপারে যতটুকু সম্পর্ক রাখা দরকার সে সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। এর বাইরে কিছুই না।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বিএনপির রাজনীতি করি। মোজাম্মেল হকের বিরোধী দলের রাজনীতি করি। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নাই। সরকারি কোনো প্রোগ্রামে তিনি আসলে ডিসি, এসপি আমাকে থাকতে বললে আমি থাকতাম।’
কেকে/ এমএস