রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসেবে পরিচিত বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। বিভিন্ন দুঃসময়ে পাশাপাশি হেঁটেছে রাজনৈতিক দল দুটি। একসঙ্গেই মোকাবিলা করেছে নানা ক্রান্তিকাল। পরিস্থিতি বিবেচনায় মাঝে-মধ্যে নানা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন দুপক্ষের নেতারা, হয়েছে মান-অভিমানও। তবে কখনো চূড়ান্তভাবে দূরে সরে যায়নি তারা। এবার ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর কাছাকাছি এলেও জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময়ের কথা বললেও জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। জামায়াত তাড়াহুড়া না করে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। এসব ছাড়াও এখন আরো কিছু ভিন্ন ইস্যু এতে যোগ হয়েছে। চলছে নেতাদের বাহাস।
রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আজকে সব গণতন্ত্রমনা শক্তির এক জায়গায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু এই শক্তিকে ফাটল ধরিয়ে দুই-একটি রাজনৈতিক দল নিজেদের ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন, এ দেশের মানুষ সব জানে। আমি সেই রাজনৈতিক দলটিকে বলতে চাই, খুব নীরবে আপনারা সব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। শেখ হাসিনার ব্যাংক আত্মসাতের পর, ৫ আগস্টের পর আপনাদের আত্মসাতের ঘটনাও জনগণ দেখেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার আমলে যারা ব্যাংক লুট করেছে, ব্যাংক আত্মসাৎ করেছে, এস আলমদের উত্তরসূরি হিসেবে ৫ আগস্টের পর আমরা কি ব্যাংক আত্মসাৎ হতে দেখিনি? আমরা তো দেখেছি একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা কীভাবে ইসলামী ব্যাংক গ্রাস করে নিল। তাহলে কোন মুখে বলছেন ‘এক চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেক চাঁদাবাজকে কেউ দেখতে চায় না।’ কাকে উদ্দেশ করে এসব বলছেন, আমরা কি বুঝতে পারি না?’
রিজভী বলেন, ‘আমরা তো প্রথমেই দেখলাম ৫ আগস্টের পরদিনই ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে, এটা তো দেখেছে জনগণ। আজকে বড় বড় কথা বলেন। কলঙ্ক লেপন করার চেষ্টা করেন বিএনপির নামে। জেলায় জেলায় টার্মিনাল দখল, সিএনজি স্ট্যান্ড দখল, টেন্ডার ভাগাভাগির মধ্যে কি আপনাদের লোকরা জড়িত নয়?’ জামায়াতের নাম না নিয়ে রিজভী আরো বলেন, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছেন। আপনাদের ৭১-এর অর্জন কী? আপনারা ৭১-এর বিরোধিতা করেছেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন, এ গৌরব বিএনপির। ৭১, ৯০-এর গৌরব বিএনপির।’
তিনি বলেন, ‘আমরা হাসিনা আমলে দেখেছি চাপাতি লীগ, হেলমেট লীগ, বন্দুক লীগ। আবার জনগণ এটাও জানে ক্ষুর লীগ, পায়ের রগ কাটা পার্টি। এরা কারা জনগণ কি জানে না? কারা পায়ের রগ কাটে, তাদের জনগণ ঠিকই চেনে। জনগণ জানে কারা দেশপ্রেমিক, কারা স্বাধীনতা বিশ্বাস করে, কারা সার্বভৌমত্ব বিশ্বাস করে, কারা বহুদলীয় গণতন্ত্র বিশ্বাস করে।’
তবে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর এই বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। রোববার সন্ধ্যায় দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান প্রদত্ত এক বিবৃতিতে এই প্রতিবাদ জানায় দলটি। সেখানে রিজভীর বক্তব্যকে বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “রিজভী ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ‘শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায় জামায়াত’ মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে জনগণ বিস্মিত। ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে জামায়াতের প্রতি অভিযোগ উত্থাপনের আগে জনাব রিজভীর আত্ম-পর্যালোচনা করা উচিত। কারা দলীয় টিম নিয়ে ভারত সফর করে ভারতের সাথে সখ্যতা করার চেষ্টা করেছেন, তা জনগণ খুব ভাল করেই জানেন।”
মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াতের এই ভূমিকা গোটা জাতি গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই সম্ভবত জনাব রিজভীর গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অপবাদ আরোপের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিবৃতিতে তিনি আরও বলা হয়, “জনাব রুহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘৫ আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ দেখেছে জনগণ, কারা পায়ের রগ কাটে তাদের চিনে জনগণ, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে একাত্তরের বিরোধিতাকারী জামায়াত।’ জনাব রিজভীর এ জাতীয় বক্তব্য বিগত কয়েক দশক যাবৎ প্রচার করা হচ্ছে। রগ কাটা, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার, ৭১ এর বিরোধিতা এ সব জনাব রিজভী জামায়াতের বিরুদ্ধে এসব কথা উচ্চারণ করে কী অর্জন করতে চান, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনো করেনি। তিনি জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করে ‘ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না’ তার এই বক্তব্য চরম মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। জামায়াত ‘ইসলাম’ নিয়ে রাজনীতি করে না। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করে জামায়াত। জামায়াতে ইসলামী কখনো মোনাফেকি করেনি। জামায়াত দেশের মানুষের অধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপসহীনভাবে লড়াই করেছে। জামায়াত কখনো মোনাফেকির আশ্রয় নেয়নি। জনাব রিজভী অবশ্যই অবগত আছেন ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্ন মতের লোকদের সাথে জোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য করা হয়েছিল তা কী জাতির সাথে মোনাফেকি নয়? জনগণ এই রাজনৈতিক ছন্দ পতনের ইতিহাস ভুলে যায়নি।”
এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে আমাদের ওপর যারা জুলুম-নির্যাতন করেছে, আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আমরা সংশোধন ও ক্ষমার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তবে কোনো ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার যদি আইনের আশ্রয় নেয়, তাহলে আমরা তাদেরও সহযোগিতা করব। দল হিসাবে আমরা কোনো প্রতিশোধ নেব না।’
সে সময়ও জামায়াত আমিরের বক্তব্যের সমালোচনা করেন রিজভী। তিনি বলেন, ‘গণহত্যাকারীদের কীসের ক্ষমা করতে বলেছেন তারা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার নির্দেশে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তাদের হত্যাকারীদের ক্ষমা করলে নিহতদের আত্মার সঙ্গে বেইমানি করা হবে। ট্রাইব্যুনাল করে প্রতিটি হত্যার বিচার, প্রতিটি অপরাধের বিচার করতে হবে।’
তবে জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, মাঠে অনেক রাজনৈতিক কথা হয়, তাতে বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে তারা মনে করেন না। সব দলই সংস্কার চায়। তারা সংস্কারের জন্য কোনো সময় বেঁধে দিতে চান না। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে কোনো ঘাটতি হয়েছে বলে মনে করেন না। তবে এখন তারা বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত নয়। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। তারা ইসলামি দল ও সংগঠনের সঙ্গে এখন আলাপ-আলোচনা করছেন সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে কোনো জোট করবেন কিনা, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর বিএনপির ব্যাপারেও তাদের একই অবস্থান। এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিএনপির নেতারা জানান, তারা এখন এককভাবে চলতে চান। কারণ এখন দেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করবেন কি না, তখন সিদ্ধান্ত নেবেন। সামনে এখনো রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ আছে।
জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে। অনেক আগেই আমরা যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রোগ্রাম ঠিক করে যুগপৎ আন্দোলন করেছি সরকার পতন অবধি। এটা এখন বলবৎ নেই। তবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আমরা আলোচনা অব্যাহত রেখেছি, কারণ এখনো কেয়ারটেকার সরকার আছে, এরপর নির্বাচন আছে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমরা আলোচনা বজায় রাখছি, এটা জরুরি। এ মুহূর্তে আমাদের কোনো জোট নেই। আমরা জোটবদ্ধ নই।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। নেতাকর্মীরা হয় পালিয়েছেন, নয় আত্মগোপনে। আবার কেউ কেউ আটক হয়েছেন। তাই রাজনীতির মাঠে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফাঁকা জায়গায় একটি বড় শক্তি হিসাবে সামনে আসতে চাইছে জামায়াত। কিন্তু এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ জামায়াতের যে ভোট ব্যাংক, তা খুব বেশি বাড়বে না। তারা আরো মনে করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। তারা সহযোগিতা করছেনও। তবে নির্বাচনের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময়ের কথা বলা বা রোডম্যাপ চাওয়া দোষের কিছু নয়। এটি চাওয়াও একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ নিয়ে ‘অতিকথন’ রাজনীতির জন্য সুখকর নয়।
কেকে/এমএস