স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানকে মুজিববাদী আখ্যা দিয়ে আগামীকাল সেটির কবর রচনার ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে তাতে সাড়া যে পাবে না, তা ডাকের দিনই স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সরাসরি বলেছে, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, এটি একটি বেসরকারি উদ্যোগ। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশের সংবিধানের কবর দেওয়ার ঘোষণাকে ফ্যাসিবাদী বলেছেন বিএনপির এক নেতা।
‘সংবিধান কবরস্থ ঘোষণা করা হবে’
৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে ‘নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে’ বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে বলে আশা করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ঘোষণাপত্রে মুজিববাদী সংবিধান ‘কবরস্থ’ ঘোষণা করার দাবি তাদের।
রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আগামীকাল ৩১ ডিসেম্বর বেলা ৩টায় জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই ঘোষণাকে সামনে রেখে রোববার দুপুরে বাংলামোটরে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ কথা বলেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা চাই, মুজিববাদী সংবিধানকে কবরস্থ ঘোষণা করা হবে। যেখান থেকে এক দফার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকে মুজিববাদী বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচিত হবে। আমরা প্রত্যাশা রাখছি, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে।’
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রটি ৫ আগস্টেই হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, এটি না হওয়ার কারণে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী পাড়াসহ সব জায়গায় ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। দুই হাজারের বেশি শহিদ ও ২০ হাজারের বেশি আহতের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এর বৈধতা নিয়ে (লেজিটিমেসি) প্রশ্ন তুলছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা বিপ্লবের একটিমাত্র ধাপ অতিক্রম করেছি। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আরো আগে ঘোষণা করা প্রয়োজন ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এ বিপ্লব যেমন ফ্যাসিস্টবিরোধী সবাইকে ধারণ করতে পেরেছিল, এ ঘোষণাপত্রও সবার আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে পারবে।’
এর মধ্যে ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া করা হয়েছে বলে জানান সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘এই বিপ্লবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মত, ধর্ম ও বয়সের যে মানুষেরা সরাসরি অংশ নিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এটি সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হচ্ছে।
মুজিববাদী সংবিধানের রিপ্লেসমেন্ট
এক প্রশ্নের জবাবে হাসনাত বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিগুলোর মাধ্যমে ভারতীয় আগ্রাসনের ইনস্টলমেন্ট হয়েছে। ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট করা হবে, মুজিববাদী সংবিধান কীভাবে গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে বিনষ্ট করেছে এবং ঠিক কীভাবে আমরা এটার রিপ্লেসমেন্ট করতে চাই।...সেকেন্ড রিপাবলিক আইনগত বিষয়। এখন এ বিষয়গুলোর দিকে আমরা যাচ্ছি না।’
এ সময় হাসনাতের পাশে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করব। সেটা সংবিধানে যুক্ত করে সেকেন্ড রিপাবলিক করার দায়িত্ব সরকারের।’
‘এ ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের যে ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হবে, তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মো. শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, এটিকে সরকার ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ (বেসরকারি উদ্যোগ) হিসেবেই দেখতে চায়।
রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে করা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম এ কথাগুলো বলেন। তিনি বলেন, ‘এটি একটি প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ। আমরা এটিকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ হিসেবেই দেখছি। সরকারের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যারা এটিকে সাপোর্ট করছেন, এটা প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভকে সাপোর্ট করছেন।’
সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ নিয়ে আরো বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
‘সংবিধানকে কবর দেওয়ার কথা শুনলে কষ্ট লাগে’
শহিদের রক্তের ওপর লেখা সংবিধানকে কবর দেওয়ার কথা শুনলে কষ্ট লাগে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, সংবিধানে খারাপ কিছু থাকলে তা বাতিলযোগ্য। এ সংবিধানকে সংশোধন বা পুনর্লিখন করা যাবে। তবে কবর দেওয়া হবে এভাবে বলা ঠিক নয়। এগুলো ফ্যাসিবাদের ভাষা।
রোববার রাজধানীর নয়াপল্টনের একটি কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপি কখনো ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বলে না। দলটি শুধু নির্বাচন ও ভোটাধিকার চায়। কেউ যদি মনে করে যা খুশি তাই করব, সেটি ভালো লক্ষণ নয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন নিভু নিভু অবস্থায়, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে নামে। এককভাবে কেউ কিছু দাবি করলে জনমনে বিভেদ সৃষ্টি হবে।
কেকে/এমএস