আওয়ামী লীগের আমলাতন্ত্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমলারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। গত কয়েক মাস ধরে আমলারা অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়কে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের পরিকল্পনায় সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলেও অনেকে অভিমত দিয়েছেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী ও দুর্নীতিবাজ আমলারা অন্তর্বর্তী সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতে সব সরকারই নিজ স্বার্থে কম-বেশি আমলাদের ব্যবহার করেছে। তবে পতিত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে আমলারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে। তারা দুর্নীতি করেছে, সুবিধাও নিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী সরকার ২০১৮ সালের আগে আমলাদের ভূমিকা পালনের জন্য আগাম পুরস্কার হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ভোটারবিহীন নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ফের ক্ষমতায় বসিয়ে সে পুরস্কারের প্রতিদান দেন তারা। এর মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকার জন্য আমলারা ক্রেডিট নিতে শুরু করে। অনেকে বলতে থাকেন তারাই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন।
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে জনপ্রশাসনে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব করা হয়। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিব পদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা দুইগুণ ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যেই অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধা পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নতুন সরকারকে সহযোগিতা করছেন না। সব মিলিয়ে ক্ষমতা বদলের ছয় মাস পরও প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। সরকারি সব কর্মকাণ্ডে দেখা যাচ্ছে ধীরগতি, যা নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে প্রশাসন সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে জিম্মি ছিল বলে অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সামনে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলারা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘উন্নয়ন প্রশাসনের মধ্যে কিছু অসাধু কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের প্রভাব ছিল। অনেক আমলা রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে এ ধরনের কাজে জড়িত ছিলেন।’
মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারে আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে কমিশন গঠন করে। তিনি উপসচিবদের পদোন্নতি দিয়ে পরীক্ষা এবং প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশের সুপারিশের কথা জানান। এরপরই আওয়ামী লীগের সুবিধা নেওয়া আমলারা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে অপসারণ করতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির ব্যানারে। সমিতির পক্ষে সভাপতি এ বি এম আব্দুস সাত্তার তার অপসারণ দাবি করে বক্তব্য দেন। সরকার তাকে অপসারণ না করলে কীভাবে অপসারণ করতে হয় আমাদের সেই টুলস জানা আছে বলেও সরকারকে হুমকি দেন তিনি। মাঠে নামেন অন্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারাও। এরই মধ্যে তারা প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করে কলম বিরতি, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ বেশ কিছু কর্মসূচিও পালন করেছে এবং আগামী ৩ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা দুর্বল হওয়ায় আমলারা সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে হুমকি দেওয়ার মতো স্পর্ধা দেখাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের মূল কাজগুলো করেন আমলারা। তারা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সঠিকভাবে গাইড না করেন বা সহযোগিতা না করেন, তাহলে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। এ আমলারা ১৫ বছর হাসিনাকে খুশি করতে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। হাসিনা পালিয়েছে কিন্তু আমলারা রয়ে গেছে। ফলে সচিবদের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা জিম্মিদশায় পড়েছেন।
রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘একটা সংস্কারের পরামর্শ নিয়ে তারা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে আমরা মনেকরি এটা নৈতিকভাবে ঠিক হয়নি। তারা বিধিও লঙ্ঘন করেছেন। যারা আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিগত রেজিমের যে আমলারা লুকিয়ে আছে নানাভাবে এখনো, তাদেরও আমরা চিহ্নিত করেছি। এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছে, তাদের বিরুদ্ধেও খুবই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ‘জনগণ নয়, বিগত সরকার ছিল আমলাদের দ্বারা নির্বাচিত। ফলে রাজনৈতিক ভিত্তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আমলারা নিয়মের মধ্যে না থেকে শেখ হাসিনা কী ইঙ্গিত দিয়েছেন তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন, বিশেষ করে শেষের ১০ বছর। অনিয়ন্ত্রিত ও সুবিধাবাদী আমলাতন্ত্র লুটপাট করেছে, যেভাবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা মেগা দুর্নীতি করেছে, তার ভাগ পেয়েছে আমলারা। ফলে তারা মনে করছেন মন্ত্রীরাও চুরি করেছে, আমরাও চুরি করেছি। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।’
ড. নুরুল আমিন বলেন, ‘হঠাৎ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের দেড় মাসের মাথায় হাসিনা পালিয়ে গেল, তারপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলো। প্রথম ১০-১৫ দিন ঠিক ছিল। কিন্তু যখন আমলারা দেখল উপদেষ্টারা শক্তিশালী নয়, তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তখন তারা বেপরোয়া হয়ে গেল। এখন তারা সচিবালয়ে মিছিল শুরু করে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার ফেল করলে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা টেকওভার করবে সেনাবাহিনী। যেভাবে ১/১১-এর সময়ে ভয় পেয়ে সবাই ঠিকমতো কাজ করেছে, এবারো সেভাবে কাজ করবে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা যায় তখন এই আমলারা নিয়মের মধ্যে আসবে। জননির্বাচিত সরকারের প্রতি তাদের জবাবদিহি থাকবে। এছাড়া অযোগ্য উপদেষ্টাদের বাদ দিতে হবে। উপদেষ্টাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নীরবে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এদের প্রতি আমলারা আস্থা হারিয়ে ফেলছে। ফলে যোগ্যতাসম্পন্ন উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে হবে এবং আমলাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমলাতন্ত্র হলো একটা স্থায়ী গোষ্ঠী। তাদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে এখন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, যেটা উচিত না। তাদের নিয়োগবিধি অনুযায়ী তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। সংস্কারে বাধা দেওয়া মানে ৫ আগস্টের মূল স্পিরিটকে বাধা দেওয়া, এটা কখানো কাম্য না। এটা সরকার, আমলা এবং অন্যান্য স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে নিয়ে এ সংকটের সমাধান করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু গত ১৫ বছরে নিয়োগ পাওয়া আমলাদের সংখ্যা বেশি। ফলে সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে তদন্ত করে দেখতে হবে তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ কাজগুলো করছে কিনা। যদি বোঝা যায় আমলারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে যাচ্ছে, তখন সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে।’
কাজী মাহবুব আরো বলেন, ‘আমলারা যেন সরকারের সংস্কারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারে, এ ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। ৫ আগস্টের পর সরকারের যে পরিমাণ ক্ষমতা কাঠামোর পুনর্গঠন দরকার ছিল, সেটা সরকার করতে পারেনি। যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা অনেকটাই নিরপেক্ষ। আবার অনেকেই আছেন যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল, তারাও রয়ে গেছে। এ অবস্থার কারণে সরকার চ্যালেঞ্জে পড়েছে।’
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আশরাফ কায়সার বলেন, ‘আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কোনোদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমলারা গণতন্ত্রে সবচেয়ে বড় শত্রু। নিজেরা নিজেরা সংস্কার করলে সেটি কোনো সংস্কার হয় না। বাংলাদেশের আমলারা আমাদের এখন গান পয়েন্টে রেখেছেন, চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়েছেন। গত ১৫ বছরের দুর্নীতির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী আমলারা। তারাই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিচ্ছেন, পরোক্ষভাবে সরকার পতনের হুমকি দিচ্ছেন এবং এদের পথ অনুসরণ করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বসে রয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমলাতন্ত্র এ সরকারের সবচেয়ে বড় বাধা এবং সব ব্যর্থতার কারণ হবে। কিন্তু তারা বলবে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, আমরা ব্যর্থ হইনি। ফলে আমলাদের সঙ্গে কঠোর হতে হবে।’
আশরাফ কায়সার বলেন, ‘সচিবালয়ের যে ঘটনা ঘটেছে এটি বুঝতে সাত দিন সময় লাগে না। এটি কমনসেন্স ওয়ালা যে কেউ বুঝতে পারছেন। কারণ তিনটি যায়গায় একসঙ্গে আগুন লেগেছে। বিদ্যুতের শর্টসার্কিট কি এভাবে ঘটে কাজ করে, করে না। ৭ দিন মানে ধামা চাপা দেওয়া। যারা নাশকতা করেছে। তাদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি কি বলবে আমরা এই কাজটি করেছি। তার মানে এটি আইওয়াস। এটি অক্ষমতা প্রকাশ করে একটি সরকারের। একটি সরকারের যে সাহস থাকার কথা, কঠোরতা থাকার কথা সেটি হয়নি।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘আমলারা যা করছে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। ভেতরে ভেতরে ব্যবস্থা না নিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে, নাহলে এটা উদাহরণ হয়ে যাবে। পুলিশকে আমরা বেশি শত্রু মনে করছি, কারণ তার হাতে বন্দুক থাকে। অথচ শেখ হাসিনকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী আমলারা। কারণ নির্বাচনের নামে প্রহসনগুলো তাদের তত্ত্বাবধানে হয়েছে।’
কেকে/এমএস