গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ঘন কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে পুরো এলাকা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সূর্যের কোনো আলোর দেখা মেলেনি। তীব্র শীতের প্রকোপে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়।
বুধবার (১ জানুয়ারি) সারাদিন ধরে ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাসে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। শীতের তীব্রতায় বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশাচালক, কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও দৈনন্দিন কার্যক্রমেও প্রভাব পড়েছে।
শীতের কারণে বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশাচালক, কৃষক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে গেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ এবং শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকের জন্য জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে।
এদিকে কৃষকরা শীতের তীব্রতার কারণে ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তাদের ফসল, বিশেষ করে গম, সরিষা এবং বোরো ধানের বীজতলা এই শীতের প্রকোপে বিপন্ন হচ্ছে। কৃষকরা জানাচ্ছেন, সূর্যের আলো না পাওয়ার কারণে ফসলের বৃদ্ধিতে সমস্যা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন ও সহায়ক সংস্থাগুলোর সহায়তা জরুরি হয়ে উঠেছে, যেন শীতের এই প্রকোপের মধ্যেও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন চলতে পারে।
রিকশাচালক ও দিনমজুরদের দুর্ভোগ
সুন্দরগঞ্জ পৌরশহরসহ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট আজ ফাঁকা। মানুষের চলাচল কম থাকায় রিকশাচালকরা দিনভর অলস সময় কাটিয়েছেন।
স্থানীয় রিকশাচালক মজনু মিয়া বলেন, 'সকাল থেকে রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। মাত্র দুটো যাত্রী পেয়েছি। ঠান্ডায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা খুব কষ্টকর। ঘরে খাবার না থাকলে কীভাবে বসে থাকব? কিন্তু রিকশা চালিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।'
দিনমজুর আকবর আলী জানান, 'শীতের জন্য কেউ কাজের জন্য ডাকছে না। গত দুই দিন ধরেই কাজে যেতে পারছি না। ঘরে ছেলে-মেয়েরা খেতে চাইছে, কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে?'
স্থানীয় বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, 'আমাদের ঘরে একটাও গরম কাপড় নেই। বাচ্চাগুলো সারাদিন কম্বলের নিচে কাঁপছে। সরকার যদি শীতবস্ত্র না দেয়, তাহলে কষ্টে দিন কাটবে।'
চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ১৫ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে ৭টি ইউনিয়ন চরাঞ্চলভুক্ত। এই চরাঞ্চলগুলোর বাসিন্দারা সাধারণত নদী পাড়ে বসবাস করেন এবং তাদের জীবনযাত্রা নদীভাঙন, শীতের তীব্রতা, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেকটাই দুর্বিষহ।
এই চরাঞ্চলগুলোতে তীব্র শীতের প্রকোপ আরও বেশি অনুভূত হয়। কারণ এখানে ঘন বসতি না থাকায় শীতের মধ্যে গরম কাপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা পৌঁছানো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া চরাঞ্চলের কৃষি কাজও শীতের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে, কারণ এখানে কৃষিকাজ নির্ভর করে মূলত বর্ষা মৌসুম ও শীতকালীন ফসলের ওপর।
এছাড়াও কৃষকরা শীতের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা তাদের জীবিকা নির্বাহের মূল উপায়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে স্থানীয় প্রশাসনের আরও উদ্যোগ এবং ত্রাণ কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে গেছে।
চরাঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, শীতের কারণে তাদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলের বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, 'আমরা সাধারণত নদীর পাশে বাস করি। কিন্তু এই শীতের কারণে আমাদের জন্য জীবনযাপন অনেক কঠিন হয়ে গেছে। রাস্তায় কোনো পরিবহন নেই, তাই আমরা হাঁটতে হাঁটতে কাজ করতে যেতে হয়।'
আরেক চরবাসী হাসনা বেগম জানান, 'আমাদের ঘরগুলো তেমন শক্ত নয়, শীতের বাতাস ভিতরে ঢুকে আমাদের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। বাচ্চাদের জন্য পোশাক নেই, তারা সারাদিন কাঁপছে।'
একজন কৃষক আলেপ উদ্দিন বলেন, 'চরাঞ্চলে কৃষি কাজ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। কুয়াশা আর ঠান্ডায় ক্ষেতের ফসলের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আমাদের কাছে গরম কাপড়ও নেই, যেগুলো কিনতে পারি তাও মূল্য বেশি।'
কৃষকের দুশ্চিন্তা: বীজতলার ক্ষতি
শীতের প্রকোপে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বোরো ধানের বীজতলা এবং শীতকালীন ফসল সরিষা ও গমের চাষে কুয়াশার প্রভাব পড়ছে।
কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, 'বোরো ধানের বীজতলা কুয়াশার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সূর্যের আলো না পেলে ধানের চারা নষ্ট হয়ে যাবে। কীভাবে ফসল বাঁচাব, বুঝতে পারছি না।'
আরেক কৃষক নুরুল ইসলাম জানান, 'গমের জমি ভালোভাবে পরিচর্যা করতে পারছি না। কুয়াশা আর ঠান্ডায় গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে চললে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।'
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাশিদুল কবির বলেন, 'আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি কুয়াশা থেকে বীজতলাকে রক্ষা করতে এবং হালকা সেচ দিতে। তবে শীতের প্রকোপ এভাবে বাড়তে থাকলে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।'
শীতজনিত রোগের প্রভাব
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, 'ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। শিশু ও বয়স্করা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও হাঁপানির সমস্যায় ভুগছেন। আমরা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি, তবে গরম পোশাক ও সচেতনতার অভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।'
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সকাল থেকেই রোগীর ভিড় ছিল। প্রায় ৭০ ভাগ রোগী ছিলেন শিশু ও বয়স্ক, যারা ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।
ত্রাণ কার্যক্রম ও অভিযোগ
শীতবস্ত্রের চাহিদা থাকলেও তা এখনো অনেক গ্রামে পৌঁছায়নি। স্থানীয় বাসিন্দা জরিনা বেগম বলেন, 'গত বছর ত্রাণের কম্বল পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার এখনো কিছু পাইনি। আমাদের গ্রামে অনেক পরিবার শীতে কষ্ট পাচ্ছে।'
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজির হোসেন বলেন, 'শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু হয়েছে। নতুন বরাদ্দ এলেই তা দ্রুত বিতরণ করা হবে।'
আবহাওয়া পূর্বাভাস: শীত আরও বাড়তে পারে
রংপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, আগামী কয়েকদিন উত্তরাঞ্চলে একই রকম আবহাওয়া থাকতে পারে। ঘন কুয়াশা এবং সূর্যের অভাবের কারণে তাপমাত্রা আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও এর আশপাশের অঞ্চলে শীতের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। শীতের কারণে জনজীবনে আরও বিঘ্ন ঘটবে এবং কৃষকদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তীব্র শীতের কারণে শিশু, বৃদ্ধ ও শীতের রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে পারে। এর ফলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রোগীদের চাপ বাড়বে। শীতবস্ত্রের অভাব এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর আরও সক্রিয় পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।
মানুষের দাবি: সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম বাড়াতে হবে
শীতের এই তীব্রতায় নিম্ন আয়ের মানুষ শীতবস্ত্র ও ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেছেন, সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। সুন্দরগঞ্জের মানুষ শীতের প্রকোপ মোকাবিলায় প্রশাসনের কাছ থেকে দ্রুত উদ্যোগ ও সহায়তা কার্যক্রম চালানোর দাবি জানিয়েছেন। এখন সময়ের অপেক্ষা, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এই চরম পরিস্থিতি মোকাবিলা করার।
কেকে/এআর