দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি থামছেই না। প্রশাসনের তৎপরতা সত্ত্বেও এ ধরনের অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলছে। সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজরা সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে করছে অর্থ আদায়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, সভা-সেমিনারসহ সামাজিক কার্যক্রমের নামে তারা এসব অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির বেশ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।
ফেনীতে প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ককে। গ্রেফতারকৃত সমন্বয়কের নাম ওমর ফারুক শুভ। গ্রেফতারের আগেই তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গ্রেফতার ওমর ফারুক শুভ ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগর ইউনিয়নের জগতজীবনপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের ছেলে। গত আগস্টে আন্দোলনে শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকায় তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফেনী জেলার সহ-সমন্বয়ক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কার হওয়ার পরও গত কয়েক মাস ধরে জেলার অন্য সমন্বয়ক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়েই বিভিন্ন কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছিলেন তিনি।
জানা যায়, ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসার সাময়িক বরখাস্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে স্বপদে বহাল রাখার আশ্বাস দিয়ে চাঁদা দাবি করেন শুভ। সেই ঘটনার কল রেকর্ড ফাঁস হলে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ভাইরাল ওই কল রেকর্ডে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ও হামজা মাহবুবের কথা বলে অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসানের কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
এর আগে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে চাঁদাবাজির চেষ্টাকালে নয়জনকে আটক করে স্থানীয়রা। পরে তাদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাত দুইটার দিকে উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, বুধবার রাতে ইসলামপুরে নৌকার শ্রমিক ও মাঝিদের কাছে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করে তারা। একপর্যায়ে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নয়জনকে আটক করা হয়।
এছাড়াও গত বছরের ২৬ অক্টোবর ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে রাজধানীর উত্তরার একটি হোটেলে চাঁদাবাজির অভিযোগে দুই তরুণীসহ নয়জনকে গ্রেফতার করে যৌথবাহিনী। তারা উত্তরার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। গ্রেফতারের পর সকালে তাদেরকে চাঁদাবাজির মামলায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পাঠানো হয়। পরে বিচারক শুনানি শেষে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সমন্বয়কের ভুয়া পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, মার্কেট, ফুটপাত, বাজার, ভাঙ্গারির দোকান, খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন জায়গায় অনৈতিক সুবিধা দাবি করে আসছিলেন। শুধু তাই নয়, অবৈধ টাকা ও অস্ত্র রয়েছে অভিযোগ তুলে তারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীর বাসায় ঢুকে চাঁদা আদায় করেন। দল বেঁধে গিয়ে যেভাবে যা পারত নিয়ে আসত।
পর্যটর শহর কক্সবাজারে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে মোহাম্মদ শরীফ নামের এক যুবককে আটক করেছে জনতা। এ ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযাগে মনির খান নামের আরেকজনসহ দুজনের নামে মামলা করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত দুজন মোবাইল ফোনে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের পিএমখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা ফারুক আহমদ বাবুলের কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। বেশ কয়েক দিন ধরেই তারা নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন।
এদিকে, জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে সমন্বয়ক পরিচয়ে ক্যান্সার রোগীর কথা বলে চাঁদা তুলতে গিয়ে তিনজন ভুয়া সমন্বয়ককে আটক করেছেন সাধারণ জনতা।
আটকরা হলেন- সরিষাবাড়ি উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের ওয়াদুদের মেয়ে ও সরিষাবাড়ী মাহমুদা সালাম মহিলা কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বৈশাখী আক্তার (২১), চর পোগলদিঘা গ্রামের বাদল মিয়ার ছেলে রিফাদ হাসান (১৮), চর পোগলদিঘা গ্রামের বাদল মিয়ার ছেলে ও সরবান হাসান টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রিফাদ হাসান (১৯) ও একই ইউনিয়নের রুদ্র বয়ড়া একুশে মোড় এলাকার সুরুজ আলীর ছেলে ও আলহাজ্ব মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সিফাত আহমেদ (১৯)।
আটক বৈশাখী বলেন, আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আকুল মিয়ার নির্দেশে একজন ক্যান্সার রোগীকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তুলি। উত্তোলনকৃত প্রতিদিনের টাকা রাতে সমন্বয়ক আকুল মিয়ার কাছে জমা দেই। তিনি এই টাকা দিয়ে কী করেন তা আমরা জানি না। এছাড়া রিফাত ও সিফাত বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমন্বয়ক পরিচয়ে টাকা উত্তোলন করার কথা স্বীকার করেছেন।
রাজশাহীতে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রাজকে গণধোলাই দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তার বিরুদ্ধে নিজেকে সমন্বয়ক দাবি করে চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। তবে সোহেল রাজ অভিযোগ করে বলেন, তাকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে আহত করেছেন। তবে ছাত্রদলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে নিজেকে সমন্বয়ক দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন সোহেল। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরীর সমন্বয়কদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। সেসব ছবি দেখিয়ে নিজেকে সমন্বয়ক দাবি করে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করতে থাকেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাকে একাধিকবার সতর্ক করে। তারপরও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন সোহেল। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার তাকে শিক্ষার্থীরা সতর্ক করলে তাদের সঙ্গে বিতর্কে জড়ান। এ সময় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাকে পিটিয়ে জখম করেন। পরে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হন।
এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ উঠেছে। গড়ে ওঠা এ সিন্ডিকেটের কয়েকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কও। এই সমন্বয়কদের কাছের হওয়ায় এসব ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দেদারছে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। তারা সমন্বয়ক পরিচয় ব্যবহার করে ভাড়ায় বিভিন্ন জায়গায় বিচার-সালিশের নামে চাঁদাবাজি, লঞ্চ মালিক সমিতিকে শেল্টারের নামে টাকা নেওয়া, পুলিশ কর্মকর্তাকে মামলা থেকে বাঁচানো, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও ব্যবসায়ীদের থেকে বাজার মনিটরিংয়ের নামে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। এছাড়া জমি, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন দোকান দখল করে দিয়ে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করছে গড়ে ওঠা এই নব্য সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ চাঁদা ও দখলবাজি সিন্ডিকেটের নেৃতৃত্ব দিচ্ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মাকসুদুল হক, একই বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী মো. সোহান প্রামাণিক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মো. রাশিদুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন, ফার্মেসি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের আবু বকর খান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের একেএম পারভেজ রাকিব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১২তম ব্যাচের ফরাজি মাসুম বিল্লাহ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৬-১৭ বর্ষের সানাউল্লাহ আল ফাহাদসহ আরো কয়েকজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাঁদাবাজদের নতুন কৌশল মোকাবিলায় প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানোর প্রয়োজন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। চাঁদাবাজদের ধরতে ডিজিটাল নজরদারি জোরদার করা ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, যে কোনো প্রকল্প বা সংস্থায় গিয়ে সমন্বয়ক পরিচয়ে কেউ অর্থ দাবি করলে তার পরিচয় যাচাই করা উচিত। ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে তারা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানাতে আগ্রহী হবে। এছাড়া স্থানীয় সমাজ ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তৎপর হওয়া জরুরি। তারা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা শক্তিশালীকরণ, জনসচেতনতা এবং প্রতারণার ধরন চিহ্নিত করার মাধ্যমে এ সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
কেকে/এমএস