গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়েছে। দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের কাজ অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দেশে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এই দাবি উঠেছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও। তারা বলছেন একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা সম্ভাব্য টাইম ফ্রেম ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নমনীয়তার সুযোগে সারা দেশে বেড়ে গেছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পুলিশ প্রশাসনকে কেউ মান্য করছে না। এর মাঝেই প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে বিভিন্ন ক্যাডারদের নানা দাবি নিয়ে অস্থিরতা চলছে। এর প্রভাব পড়ছে সারা দেশের ডিসি-ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনে। ফলে অনেকটা বেকায়দায় রয়েছে সরকার।
বিষয়টি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যেন যে কেউ ইচ্ছে হলেই আন্দোলনে নামছে, রাস্তা অবরোধ করছে। যে কারণে সরকারের কঠোরতা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের কোন পথ দেখছে না বিশেষজ্ঞরা। যেটা বর্তমানের এই নমনীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিয়ে সম্ভব নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে এখন একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ফলে দ্রুততম সময়ে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিচ্ছেন এই রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
তবে এবার এই নির্বাচন নিয়ে বিভক্ত মত দিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। সমন্বয়করা বলছেন, জুলাই বিপ্লবে গণহত্যায় জড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনাসহ সবার বিচার এবং সকল সেক্টরের সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচন, তার আগে নয়। আর উপদেষ্টারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন।
গতকাল সোমবার ফরিদপুর শহরের রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে; ঠিক সেইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করতে হবে। আগে বিচার হবে, সংস্কার হবে, তারপরে নির্বাচন। তার আগে কোনোভাবেই নির্বাচন দেওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের শহীদ ভাইদের হত্যার বিচার চাই। শেখ হাসিনা দেশে আসবে, তবে এসে সরাসরি ওই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। ওই কাঠগড়া থেকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াবে।’
সারজিস আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে অবশ্যই একটি যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন হবে। তবে তার আগে এই খুনি হাসিনা আমাদের এই দেশের সিস্টেমগুলোকে যে ধ্বংস করে দিয়েছে, সেই সিস্টেমগুলোকে সংস্কার করতে হবে। আমাদের এই বাংলাদেশ আর কোনো নতজানু পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাস করে না। আমরা চোখে চোখ রেখে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করবো। পৃথিবীর কোনো বহির্শক্তি যদি আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের চেষ্টা করে তাহলে আমরা তা ছুড়ে ফেলবো।’
অপর দিকে গতকাল মুন্সিগঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গৃহায়ণ গণপূর্ত ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান জানান, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, ‘চলতি মাসের মধ্যে সংস্কার কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর সব রাজনৈতিক দলের পরামর্শ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিগগির সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি টাইম ফ্রেম দেবে। এবং সেই মোতাবেক একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।’
এদিকে ফরিদপুরের ছাত্র সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘৮ আগস্ট সরকার গঠন করার পর আজ জানুয়ারির ৬ তারিখ। এখন পর্যন্ত কিন্তু দৃশ্যমান একটি বিচারও আমরা দেখি নাই। ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি, আপনারা জানেন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর নির্বাচনে যেভাবে কারচুপি করা হয়েছে, সেগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো বিচার করা হয়নি। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আপনারা যদি আমাদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চান, অবশ্যই অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে আমাদের এই বিচারগুলো আপনার নিশ্চিত করতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক বলেন, ‘আপনারা জানেন, এখন পর্যন্ত অনেকে আমাদের বিপ্লবকে মেনে নিতে পারে নাই। সে জন্য কিছুদিন পরপর আমরা দেখি বিচার বিভাগে ক্যু করা হয়, পুলিশে ক্যু করা হয়, আনসারের বিদ্রোহ হয়, সচিবালয়ে আগুন লাগানো হয়।’
রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা সবাইকে বলতে চাই, আপনারা রিয়েলিটি মাইনা নেন। আমরা একটা দীর্ঘ সময় ধরে বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে বেড়ে উঠেছি। বিভাজনের রাজনীতি মধ্যে রেখে আমরা জাতীয় ঐক্যে কখনো পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের পূর্বের যারা রাজনীতিবিদ রয়েছেন, আপনাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সেগুলোকে আমরা তরুণ প্রজন্ম সম্মান জানাই। ফ্যাসিবাদকে বাংলাদেশ থেকে উৎখাত করার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের যে প্রত্যয়, আপনাদের প্রজ্ঞার সঙ্গে তাদের প্রত্যয়ের যদি সম্মিলন ঘটাতে না পারেন, তাহলে ২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা ব্যর্থ হব।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা আরও বলেন, ‘১৫ জানুয়ারির মধ্যে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপনাদের রক্তের স্বীকৃতি দিক, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুনি হাসিনার বিচারের একটি স্পষ্ট বার্তা দিক, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রক্লামেশন অব জুলাই রেভল্যুশনে জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটুক।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমাদের এই ভাবনা ছিল বাংলাদেশের দুটি জেলা স্বাধীন হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। তার একটি ফরিদপুর। ৩, ৪, ৫ আগস্ট ফরিদপুরবাসী যে গণজোয়ার দেখিয়েছে, তাতেই শেখ হাসিনার পতনের ভিত রচিত হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের কথা বলেছি। আপনারা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে এই অভ্যুত্থানে সফল করেছেন। এই অভ্যুত্থান সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্বীকৃতি থাকতে হবে। এই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। ২৪-এ যারা জীবন দিয়েছে, আমার শহীদ ভাইয়েরা যারা রক্ত দিয়েছে, আমাদের আহত যোদ্ধারা, তাদের স্বীকৃতি এই ঘোষণাপত্রে থাকতে হবে।’
কেকে/এমএস