হাসিনা সরকারের দীর্ঘদিনের নির্যাতন-নিপীড়নে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল দেশের মানুষ। এ সময় স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে গত সাড়ে ১৬ বছর ধরে আওয়ামী শোষক যন্ত্রের দ্বারা নিষ্পেষিত হতে থাকে মানুষ। তবে তারা দিশা খুঁজে পায় শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এবার উল্টে যায় পাশা, ঘটে গণবিস্ফোরণ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে যায় তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা। কেউ কেউ হন আটক। অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে দেশ। এ সুযোগে বেড়ে যায় নানা অপরাধ। দেশের এমন এক ক্রান্তিলগ্নে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সমর্থনে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে সরকার।
এরপর থেকে শুরু হয় একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। নির্বাচনের সময় নিয়ে শুরু হয় নানা বিতর্ক। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দিতে থাকে রাজনৈতিক নেতারা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তোলা হয়। আর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার কথা বলা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন দাবির মুখে নির্বাচনের একটা সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেন অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানান, নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য দুটি সময়সূচি তারা নির্ধারণ করেছেন। এর একটি হলো চলতি বছরের ডিসেম্বরে, আরেকটি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে। সেটা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার ওপর।
প্রধান উপদেষ্টার এ কথার সূত্র ধরেই নির্বাচনের সময় বিষয়ে ‘রাজনীতিকদের কাঁধে বন্দুক’ রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে (কেআইবি) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে বেশি সংস্কারের প্রয়োজন নেই তাহলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে সব সংস্কার চাইলে আরো ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগবে।’
শফিকুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের কাজ শেষ পর্যায়ে। সরকার বরাবরই বলে আসছে, সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ দিলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করা হবে। পরে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করা হবে।’
তিনি জানান, রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে গঠিত ছয় কমিশন ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দেবে এবং সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান তিনি। একটি ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়া সরকারের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। প্রেস সচিব বলেন, ‘মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে সরকার কিছু ভাবছে না। তবে লুটপাট, দুর্নীতি ও জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’
এর আগে গত সোমবার ফরিদপুরের এক সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করতে হবে। আগে বিচার হবে, সংস্কার হবে, তারপর নির্বাচন। তার আগে কোনোভাবেই নির্বাচন দেওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অবশ্যই একটি যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন হবে। তবে তার আগে এ খুনি হাসিনা আমাদের এ দেশের সিস্টেমগুলোকে যে ধ্বংস করে দিয়েছে, সে সিস্টেমগুলোকে সংস্কার করতে হবে।’
সারজিসের এ বক্তব্যের পর আবার নতুন করে আলোচনায় আসে নির্বাচনের সময়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচন অত্যাবশ্যকীয় মনে করেন তারা। এ পরিস্থিতিতে সারজিস আলমের এ বক্তব্যকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছে না রাজনীতিকরা।
তারা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দৃশ্যমান কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। দেশের প্রতিটা সেক্টরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। যে যেভাবে পারছে দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে। তাদের এসব দাবি পূরণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়, এগুলো করতে পারে নির্বাচিত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হচ্ছে একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তারা সে কথাটিও কঠোরভাবে আন্দোলনকারীদের বলতে পারছে না। ফলে যত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া যায় দেশের জন্য ততই মঙ্গল।
অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বলা হয় সংস্কার না করে যদি নির্বাচন দেওয়া হয় তাহলে এ বিপ্লবের কোনো মূল্য থাকবে না। সংস্কারের মাধ্যমে সিস্টেমটাকে আগে পরিবর্তন করতে হবে। তাই আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে, তারপর নির্বাচনের পথে হাঁটবে সরকার। তবে গত সোমবার মুন্সীগঞ্জে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে সরকারের গৃহায়ণ গণপূর্ত ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান জানান, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, ‘চলতি মাসের মধ্যে সংস্কার কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর সব রাজনৈতিক দলের পরামর্শ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিগগিরই সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি টাইম ফ্রেম দেবে। এবং সেই মোতাবেক একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।’
কেকে/এমএস