রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র তৈরির কথা বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য ১৫ জানুয়ারি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ইতোমধ্যে জানুয়ারির ৭ দিন পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি বিএনপি এবং জামায়াতের মতো বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও।
৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠা যে আকাক্সক্ষার জানান ছাত্র-জনতা সেদিন দিতে পারেনি তা ঘোষণার জন্য ৩১ ডিসেম্বরকে বেছে নিলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, অভ্যুত্থানের সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’
এরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ ফর ইউনিটি থেকে আল্টিমেটাম আসে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে দিতে হবে ঘোষণাপত্র। কিন্তু সপ্তাহ পার হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে দাবি করছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের এ নীতিনির্ধারক বলছেন, জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র নিয়ে যেমন অস্পষ্টতা আছে তেমনি যে দু-একটি বিষয় প্রকাশ্যে এসেছে তা নিয়েও রয়েছে দ্বিমত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সংবিধান রাখা না রাখা বা তার সংশোধনীর বিষয়ে তারা কার্যকর ভূমিকা নেবে। এটি ছাত্রদের মাধ্যমে কার্যকর হবে এমন কোনো বিষয় নয়। যোগাযোগ বলতে যেমনটা বোঝায় মতামত চাওয়া বা গুরুত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসা এমন কিছু ঘটেনি।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার জানান, এখনো তাদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়নি। এ নিয়ে তার দলের অবস্থান জানতে চাইলে বিষয়বস্তু না জেনে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘অফিসিয়ালি সরকার বা ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা বা ডিসকাশন এটা কিন্তু হয়নি। আসলে সেখানে কী থাকছে কী থাকছে না, কী পরিবর্তন হচ্ছে কী ঢুকছে এগুলো না জেনে জামায়াতে ইসলামীর মতো দায়িত্বশীল সংগঠন আগাম কোনো মন্তব্য করাটা আমি সমীচীন মনে করি না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন হয়নি বলেই এ ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সব পক্ষকে সুচিন্তিতভাবে এগোনোর পরামর্শ তাদের। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ঘোষণা হয়েছিল সেটা অনুযায়ী দেশটা চলেনি। সেজন্য আমাদের নতুন করে অভ্যুত্থান করতে হলো এবং ঘোষণা দিতে হলো। এজন্য এটা জরুরি। তাদের জাস্টিফিকেশন লাগবে না একটা।’
আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, ‘ছাত্র নেতারা যখন রক্ত দিয়েছেন তখন তারা নিশ্চয়ই খুবই দায়িত্বশীল হবে। আবার রাজনৈতিক নেতারা যতই ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করতে চায় তারাও একটা যৌক্তিক অবস্থানে পৌঁছাবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত রাজনৈতিক দল ও ছাত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করে ঘোষণাপত্র জাতির সামনে আনতে পারবে, ততই জাতীয় ঐক্যের পথ মসৃণ হবে, বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, সংবিধান হোক, আর যা-ই হোক, সিদ্ধান্ত হতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং জনগণের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, এরশাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিগত ১৫ থেকে ১৬ বছর মানুষ জীবন দিয়েছে, গুম হয়েছে, খুন হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, মানুষ তার মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য। সুতরাং সাংবিধান হোক, আর যেটাই হোক, সিদ্ধান্ত হবে জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ও সংসদের মাধ্যমে। এর বাইরে কোনো গোষ্ঠী, দল বা কোনো গ্রুপের কিছু করার সুযোগ নেই।’
অবশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এ উদ্যোগকে স্বাধীন মতপ্রকাশের জায়গা থেকে ‘স্বাগত’ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ‘ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের পর বিস্তারিত জেনে দলীয়ভাবে অবস্থান পরিষ্কার করার কথা জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, ‘ছাত্র নেতৃত্ব তাদের বক্তব্য তুলে ধরার কথা বলেছে। যে কেউ তাদের বক্তব্য দিতে পারে। যেমন জামায়াতে ইসলামী ১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, বিএনপি ৩১ দফা দিয়েছে। সে জায়গা থেকে আমরা তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি।’
যদিও এ ধরনের উদ্যোগ ‘অনাস্থা ও বিভেদ’ বাড়াবে বলেই মনে করছেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘যখন বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজন, তখন বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করাসহ বিভিন্ন বক্তব্য এবং এ ধরনের উদ্যোগ অনাস্থা-বিভেদ বাড়াবে।’
বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের মতো কিছু করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধান কবর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের বক্তব্য সাধারণত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দিয়ে থাকে। সে ধরনের যদি কিছু করা হয়, তা গ্রহণযোগ্য হবে না।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘যেহেতু ছাত্ররা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের দাবি তো থাকবেই, এটা স্বাভাবিক। তারা যে লক্ষ্যে বিপ্লব করেছে, সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তারা উদ্যোগ নেবে। দেশ মেরামতে তারা ভূমিকা অব্যাহত রাখুক। লক্ষ্য পূরণে তারা মাঠে থাকুক, এটা আমাদেরও প্রত্যাশা। কারণ আমরা দেখছি, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নেয়নি, তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। দলগুলোর চরিত্র সংশোধনের জন্য তারা একটা প্রেশার গ্রুপ হিসেবে থাকুক।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এ উদ্যোগকে নৈতিকভাবে সমর্থন করেন বলে জানান আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আরো আগেই দেওয়া উচিত ছিল। এ ছাড়া তা সবাই মিলে করা উচিত। তারা (ছাত্ররা) যেন সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেই এটি করে। যদিও একেবারে শেষ সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; তারপরও বলব, চূড়ান্ত ডকুমেন্টেশন সবাইকে নিয়ে করা উচিত।’
কেকে/এমএস