বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছিল গ্যাসের দাম। সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও তখন শিল্পের স্বার্থে মালিকরা বাড়তি দাম মেনে নিয়েছিল। কিন্তু গত দুবছরে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হলেও শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পায়নি উল্টো সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। আবারো সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে আড়াই গুণ বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণায় সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ শিল্প মালিকরা। তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে গ্যাস সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে বাড়তি দামেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস মিলছে না। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়েছে, ডলার সংকট চলমান। এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে পণ্যের দাম। অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকায় উদ্যোক্তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে নতুনভাবে বিনিয়োগ করা তো দূরের কথা পুরোনো বিনিয়োগ ধরে রাখাই কঠিন হবে।
জানা গেছে, জ্বালানি বিভাগের অনুমোদনের পর সোমবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। কমিশন সভায় বিইআরসি বাড়তি দামের অনুমোদন দিলেই বাড়বে গ্যাসের দাম। তবে এ বিষয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মঙ্গলবার বিইআরসির সচিব ব্যারিস্টার মো. খলিলুর রহমান খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, চলতি মাসের কমিশন সভা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ পরবর্তী কমিশন সভা বসবে। সেখানে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিইআরসিকে পাঠানো পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়, পুরোনো গ্রাহকের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের বাড়তি ব্যবহৃত গ্যাসের বিল হবে নতুন দামে। যেসব শিল্পকারখানা নতুন সংযোগের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আগের দাম দিতে হবে। এর বাইরে বাকি খরচের জন্য নতুন দাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
শিল্পে গ্যাস ব্যবহারের এক চিত্র তুলে ধরেছে পেট্রোবাংলা। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, শিল্পে অনুমোদিত লোডের চেয়ে ১৪ কোটি ৭৮ লাখ ঘনমিটার গ্যাস বাড়তি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ক্যাপটিভে ৫ কোটি ৭৬ লাখ ঘনমিটার গ্যাস বাড়তি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে পুরোনো কারখানায় বাড়তি এমন ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাসের বিল হবে নতুন দামে।
পেট্রোবাংলা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে দেশে উৎপাদিত গ্যাস কিনে নেয়। এতে প্রতি ইউনিটে তাদের গড়ে খরচ হয় ৬ টাকা ৭ পয়সা। এছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে খরচ হচ্ছে প্রতি ইউনিটে ৭৫ টাকার বেশি। এতে লোকসানে আছে সংস্থাটি। তবে নতুন করে ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। ফলে এখন এলএনজি আমদানির খরচ পুরোটাই শিল্পের ওপর চাপাতে চাইছে পেট্রোবাংলা।
এলএনজি আমদানি করে চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫) ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে বলে এক হিসাব দেখিয়েছে পেট্রোবাংলা। গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেনা এলএনজির খরচ হিসাব করে প্রতি ইউনিটের দাম প্রস্তাব করেছে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। এর মধ্যে আমদানি খরচ ৬৩ টাকা ৫৮ পয়সা। বাকিটা শুল্ক, কর ও পরিচালন খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন শিল্পে গ্যাসের মূল্য ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা। ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। পরে ক্যাপটিভে আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা।
গত বছরের ২৮ আগস্ট গণশুনানি ছাড়াই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিইআরসির নির্বাহী ক্ষমতা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। আইন মন্ত্রণালয়ের জারি করা গেজেটে বলা হয়, এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিইআরসি আইন ২০০৩-এর ৩৪ (ক) ধারা বিলুপ্ত হবে। এতে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারকে দিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ৩৪ (ক) ধারা প্রবর্তন করেছিল, সেটি বাতিল হয়। এর আগে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩-এর সংশোধন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আইনটির ৩৪ (ক) ধারায় সংশোধন করা হয়।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ‘আমাদের যে কার্গোগুলো আসে, আমরা তো গ্যাস অনেকখানি ইমপোর্ট করি। এটা যে দামে আসে তার চেয়ে অনেক কম দামে আমরা ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে গ্যাস দিচ্ছি। এটার বিষয়ে দাতা সংস্থাগুলোর খুব সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে যে আমরা যেন আর ভর্তুকি না দেই। কারণ সরকার ক্রমাগতভাবে ভর্তুকি দিতে থাকলে এটা তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব ফেলে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখন কোনো বিনিয়োগের সময় না। টাকা থাকলেও কেউ বিনিয়োগ করবে না। বরং এতদিন যে বিনিয়োগ হয়েছে, যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আছে ক্ষুদ্র, মাঝারি থেকে বৃহৎ তারা তাদের কর্মকাণ্ডগুলো ধরে রাখাটায় এখন অর্জন হবে। নতুন বিনিয়োগের চেয়ে পুরোনো উৎপাদন কাঠামো যা আছে সেটায় যাবে ধরে রাখা যায় সে চেষ্টা করতে হবে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন ব্যবসায়ীরা। নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দাম বাড়ার কারণ কী? আমরা তো কোনো কারণ দেখছি না। এখন তো হঠাৎ করে এমন হয়নি যে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এরকম ঘটেনি। আগের সরকার দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের চেয়ে এলএনজি কিনে বেশি উৎসাহিত ছিল কারণ সেখানে বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্য ছিল। এ সরকারের তো কমিশন বাণিজ্য নেই তাহলে আরো দাম কমার কথা।
তিনি বলেন, নতুন প্রস্তাব পাস হলে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। কেউ ৩০ টাকা দিয়ে গ্যাস কিনবে আবার কেউ দ্বিগুণ দেবে। এমন হলে নতুন উদ্যোক্তারা তো টিকতে পারবে না। বিনিয়োগই থমকে যাবে।
কেকে/এমএস