শিশুদের পুষ্টির অভাবজনিত বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ যেমন-লৌহের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা, আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড, ভিটামিনের অভাবে রাতকানা এবং প্রোটিন জাতীয় খাবার ও প্রয়োজনীয় ক্যালোরির অভাবে অপুষ্টি রোগ সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু রিকেট রোগ সম্পর্কে খুব কম লোকই জানে। পুষ্টির অভাবজনিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে চলেছে। কিন্তু রিকেট রোগ নিয়ে কার্যক্রম খুব সীমিতভাবে চলছে।
রিকেট কী?
বাড়ন্ত হাড়ের গঠনগত ত্রুটি, যা খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাবে হয়। ফলে শিশুর হাড় বেঁকে যায়, হাড়ে ব্যাথা হয়, পায়ের বিকৃতি দেখা যায়; এমনকি হার নরম হয়ে ভেঙে যেতে পারে। মূলত শারীরিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় শিশুটির।
কারণ
মূলত দেহে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব এর মূল কারণ। পাশাপাশি ফসফরাসের অভাবে এই রোগ হতে দেখা যায়। সূর্যালোকের অভাব, খাবারের ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি, খাদ্যজনিত ভিটামিন ‘ডি’ শোষণ হ্রাস পাওয়া এই রোগকে ত্বরান্বিত করে। পাশাপাশি লিভার ও কিডনির রোগের কারণে এই রোগ হতে পারে । বিভিন্ন ঔষধের কারনে বিশেষ করে খিচুনির ওষুধ দিলেই এর প্রতিক্রিয়ায় শিশুরা রিকেটস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
কীভাবে হয়?
সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে দেহে ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন খাবার থেকে যেমন তৈলাক্ত মাছ, মাছের তেল , মাখন, ডিম ইত্যাদিতে ভিটামিন-ডি পাওয়া যায়। রক্তে ভিটামিন-ডি শোষণের পর লিভার এবং কিডনিতে বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভিটামিন-ডি পরিণত অবস্থায় পৌঁছায়। রক্তে কোনো কারণে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কমে গেলে এর পরিণতি ভিটামিন-ডি খাদ্যনালী থেকে রক্তে ক্যালসিয়ামের শোষণ বৃদ্ধি করে এবং হাড়ে থাকা ক্যালসিয়াম শোষণ করে রক্তে নিয়ে আসে। ফলে হাড়ে ক্যালসিয়ামের ঘাটতিতে হাড় নরম হয়ে যায়। এ সময় শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে ওই নরম হাড় ভার বহন করতে না পেরে ধীরে ধীরে বেঁকে যেতে দেখা যায়। এভাবেই রিকেটস রোগের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের শিশুদের রিকেটেসের প্রধান কারণ হলো খাবারে ক্যালসিযামের ঘাটতি।
লক্ষণ
প্রথম বছর শেষ না হতে এবং দ্বিতীয় বছরের শুরুতেই শিশুর এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। একই রোগে আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হয় এমন শিশুদের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে যে লক্ষণ গুলো দেখা যেতে পারে-
১. খুলির হাড়গুলো নরম হয়ে যাওয়া।
২. মাথার খুলির আকৃতি চারকোনা বাক্সের মতো হওয়া।
৩. দুধদাঁত উঠতে দেরি হওয়া, দাঁত ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া।
৪. বুকের পাঁজরের হাড় গুলো বুকের সামনে বৃদ্ধি পাওয়া।
৫. বুকের খাঁচা আবার পরিবর্তিত হওয়া- কবুতরের বুকের মতন।
৬. কবজি ও গোড়ালির হাড় গুলো বেড়ে যাওয়া।
৭. হাটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পা সামনের দিকে বেঁকে যাওয়া।
৮. হাঁটুর কাছ থেকে দুই পা দুই দিকে বেঁকে যাওয়া।
৯. পা ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া।
১০. দুই পা একই সঙ্গে একই দিকে বেঁকে যাওয়া।
১১. শরীরের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে মাংসপেশি শুকিয়ে গিয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া।
১২. টিটানিতে আক্রান্ত হওয়া।
রোগ সনাক্তকরণ
রোগের লক্ষণ গুলো চিহ্নিত করে, হাড়ের এক্স-রে করে ও রক্ত পরীক্ষা করে রোগটি শনাক্ত করা যায়।
জটিলতা
শ্বাসনালীর প্রদাহ, ব্রংকাইটিস নিউমোনিয়া, আয়রন ঘাটতিতে রক্তস্বল্পতা, শারীরিক উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া, টিটানি রোগে আক্রান্ত হওয়া (রক্তে ক্যালসিয়াম কমে গিয়ে), হাড় নরম হয়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়া প্রভৃতি জটিলতা হতে পারে।
চিকিৎসা
শিশুর খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। দৈনন্দিন খাবারে ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। বিভিন্ন রকম সবজি যেমন- ঢেঁড়স, কুমড়া বিভিন্ন রকম শাক এবং কাঁটাওয়ালা ছোট মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দুধ অথবা দুধ জাতীয় খাবার দৈনিক ৬০০ মিলি লিটার খাওয়াতে পারলে ক্যালসিয়ামের দৈনিক চাহিদা পুরোপুরি মেটানো যাবে। দৈনিক ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার এবং পাশাপাশি ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।
এছাড়া ভিটামিন ‘ডি’-এর ব্যবহার ও রিকেট রোগের চিকিৎসায় প্রচলিত রয়েছে। শিশুকে নিয়মিত সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩টার মধ্যে রৌদ্রে ৩০ মিনিট সময় নিয়ে রাখলে রিকেটস রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পুষ্টি চিকিৎসা সাথে ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম ব্যবহারের ফলে ৭৫ ভাগ শিশুই সুস্থ হয়ে যায়। তবে বয়স ছয় বছরের বেশি হলে এবং পা বেঁকে যাওয়ার পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি হলে ব্রেস চিকিৎসা, আবার কখনো কখনো শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
রিকেট রোগ প্রতিরোধে প্রধানত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সচেষ্ট হতে হবে। গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে ভিটামিন ‘ডি’ দিতে হবে। শিশুদের দুধ ও খাবারে ভিটামিন ‘ডি’ সংযুক্ত করতে হবে। স্বল্প ওজনের অপরিণত শিশুর জন্মের পর দুই সপ্তাহ থেকে ভিটামিন ‘ডি দিতে হবে।
রিকেট-সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্য পুষ্টি বিষয়ক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাই এখনই রিকেট প্রতিরোধে উদ্যোগ না নেওয়া হলে আগামী দিনের নাগরিক এই শিশুদের শারীরিক অক্ষমতা ও পঙ্গুত্বের হার বাড়ার আশঙ্কা থাকবে।
লেখক: অধ্যাপক ডা. ইমনুল ইসলাম, শিশুরোগ বিভাগ, বিএসএমএমইউ
কেকে/এএম