বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই যুগেরও বেশি সময়ের ‘রানিং মেট’ বিএনপি-জামায়াত। অনেক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে একসঙ্গে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের জেল-জুলুম, হয়রানি-নির্যাতন সহ্য করেছে১ন দুদলের নেতাকর্মীরাই। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পরও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে দেখা গেছে দল দুটিকে। তবে গত দু-এক সপ্তাহ থেকে দল দুটির মধ্যে বিরোধ দৃশ্যমান হয়েছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে কথার যুদ্ধে জড়াচ্ছেন দল দুটির নেতাকর্মীরা। দিচ্ছেন নেতিবাচক বক্তব্য, করছেন বিষোদ্গার।
রাজনীতিতে দল দুটির পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা মুখোমুখি অবস্থানকে অবশ্য স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে তাদের এ বিরোধ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই নানা মেরুকরণ দেখা গেছে, সেখানে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় সেই জায়গা দখলও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এ সমীকরণের কারণে বিএনপি-জামায়াতের এক সময়কার বন্ধুত্ব এখন দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে রূপ নিচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় বদলে গেছে রাজনৈতিক সমীকরণ। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে টক্কর দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন মাঠে ছিল, তখন তারাই ছিল দল দুটির প্রধান শত্রু। এ শত্রুকে প্রতিরোধ করতেই তখন তাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক যে রাজনীতি, সেই রাজনীতিতে এ কাদা ছোড়াছুড়ি একেবারে ডালভাত। এবার আসন্ন নির্বাচনি লড়াইকে মাথায় রেখেই বিএনপি-জামায়াত পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে লিপ্ত হয়েছে।’
অনেকটা একই কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা। তার মতে, ‘রাজনীতির খেলায় সবই সমীকরণ। এতদিন যে সমীকরণের কারণে জামায়াত-বিএনপি সঙ্গে ছিল, সেই একই সমীকরণের কারণে তারা এখন একসঙ্গে থাকতে পারবে না। আর নতুন সমীকরণ তারা করবে এটাই স্বাভাবিক।’
এর সঙ্গে রাজনীতির মাঠে এককভাবে জামায়াতের নিজের জায়গা দখলেরও একটি বিষয় আছে বলেও মনে করছেন অনেকে। বলছেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় দলটির ভোটব্যাংক জামায়াতের দখল চলে যেতে পারে, আর এ নিয়ে শঙ্কা আছে বিএনপির। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জামায়াত তো কিছুটা জায়গা করে নিয়েছে বিএনপির প্রশ্রয় পেয়েই। এখন যেহেতু জায়গা হয়েছে, জায়গাটা তারা আরো বড় করতে চায়। যেহেতু আওয়ামী লীগ বর্তমানে কোণঠাসা অবস্থায় আছে, তাদের তো প্রচুর ভোটার আছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেকে আছেন যারা কখনোই বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করবে না। তাদের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছে জামায়াত যেন ওই ভোটগুলো পায়।’ আর একারণেই বিএনপি চাইছে আওয়ামী লীগ যেন মাঠে থাকে, যাতে করে জামায়াত সেই ভোটগুলো না পায়। সবাই এ ‘হিসাব-নিকাশ’ করছে বলেই মত এ বিশ্লেষকের।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানকে দলটির রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম। তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল এবং আমার মনে হয়েছে এটা একটা রাজনৈতিক কৌশল। যেভাবে তারা প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে বিরাজ করছে বা প্রতিটি কন্সটিটিউন্সিতে তারা যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলছে, সেটা আসলে রাজনৈতিক কৌশল বা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা বা তাদের রাজনীতিকে পরিচিত করার একটা কৌশল হতে পারে।’
তবে রাজনীতির নতুন সমীকরণের কারণে দুই দলের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সহসাই তা থামবে না বলেই মত বিশ্লেষকদের। তারা মনে করছে, নির্বাচনের গন্ধটা যত বেশি বেশি করে লাগবে, ততই বিএনপি-জামায়াতের এই দ্বন্দ্বটা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
জানা যায়, গত ২৯ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘৫ আগস্টের পর কি আমরা ব্যাংক আত্মসাৎ করতে দেখিনি? আমরা তো দেখেছি ইসলামী ব্যাংক কীভাবে গ্রাস করে নিলো একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা। তাহলে কোন মুখে বলছেন এক চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেক চাঁদাবাজকে কেউ দেখতে চায় না। কাকে উদ্দেশ করে বলছেন? আমরা কি বুঝতে পারি না? কারা পায়ের রগ কাটে তাদেরকে জনগণ ঠিকই জানে এবং চেনে।’
এর দুইদিন আগে ২৭ ডিসেম্বর দলটির কর্মী সম্মেলনে ‘একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। রিজভীর বক্তব্যের পর একইদিন নীলফামারীতে এক পথসভায় শফিকুর রহমান বলেন, ‘৫ তারিখের পর একদল অস্ত্র হাতে নিয়ে সেই ব্যাংক দখল করতে গেল। বোঝা গেল, ডাকাতের বেশে নতুন ডাকাত গেছে ব্যাংক দখল করতে। কেউ কেউ বললেন, ব্যাংক ওমুক-তমুক দল দখল করেছে। ব্যাংক কেউ দখল করেনি। ব্যাংক তার মায়ের কোলে ফিরে আসবে।’
এছাড়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অফিসিয়াল ফেসবুকে পোস্ট দেয় জামায়াতে ইসলামী। একইভাবে ফটোকার্ড বানিয়ে পোস্টটির জবাবও দেয় বিএনপি। এর আগে, আওয়ামী লীগ, ভারত ও নির্বাচন ইস্যুতেও দল দুটির নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। তাহলে কি এক সময়কার জোটসঙ্গী বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে?
এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত বরাবরই আলাদা দল ছিল। আওয়ামী লীগ একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু বিএনপি-জামায়াততো এক না। বিএনপির তার পলিটিক্স আছে, জামায়াতের তার পলিটিক্স আছে। ন্যাচারালি আমাদের মধ্য দূরত্ব থাকবে।’ একইসঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভিন্ন অবস্থানে থাকার বিষয়টি টেনে তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বাস করি, জামায়াত স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। মূল তো আছেই এ জায়গাটাতে।’
তবে দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়া কিংবা ‘পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের’ বিষয়টি মানতে নারাজ জামায়াতে ইসলামী। একইসঙ্গে এ ধরনের বক্তব্যকে নেতাদের নিজস্ব মন্তব্য উল্লেখ করে তা দুই দলের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করে জামায়াত।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘দলগত কোনো সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি বা আমাদের মধ্যে কোনো গ্যাপ তৈরি হচ্ছে এমন না। এটা দল ভার্সেস দল এভাবে আমরা দেখি না। গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার আছে। কোনো নেতা যদি বক্তব্য রাখেন, সেটা দলের অপিনিয়ন (মতামত) না ব্যক্তির নিজের বক্তব্য এটা জনগণ ডিসাইড করবে।’
কেকে/এমএস