ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত যত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হয়েছে তার সিংহভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছে। এখন যারা নিজেদের সংখ্যালঘু পরিচয় দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভুতি নেওয়ার করছে, আওয়ামী সরকারের আমলে তারাই রাজনৈতিক পরিচয়ে বিরোধীমত ও এলাকাবাসীর উপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে। বিদায়ী বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে সেই নির্যাতিতরাই তাদের উপর চড়াও হয়েছে। যেটাকে এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ট্যাগ দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেসব ঘটনায় তদন্ত করে গতকাল শনিবার প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। সেই প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৪ আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক দিন সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব আক্রমণ হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। এবং যে পরিমাণ সংখ্যালঘু হামলার অভিযোগ তোলা হয়েছে তার ৯৮ শতাংশই রাজনৈতিক কারণে হয়েছে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের তৈরি করা অভিযোগের তালিকা সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা এই সহিংসতার লক্ষ্যবস্তু বলে দাবি করা হচ্ছে, পুলিশ সেসব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে। পুলিশ ঐক্য পরিষদের তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেকটি স্থান, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির কাছে গিয়ে তদন্ত করেছে।
১৭৬৯টি অভিযোগের মধ্যে, পুলিশ এখন পর্যন্ত ৬২টি মামলার প্রাথমিক তথ্য নির্ধারণ করে মামলা দায়ের করেছে। তদন্তের ভিত্তিতে অন্তত ৩৫ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হামলাগুলো সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না বরং সেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে -১২৩৪টি ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ২০টি ঘটনা সাম্প্রদায়িক ছিল। কমপক্ষে ১৬১টি অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রেস উইং জানায়, পুলিশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চালু করেছে। তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অভিযোগ এলে পুলিশ সদর দফতরের একটি ফোকাল পয়েন্ট সেই অভিযোগ পর্যালোচনা করছে। প্রতিটি অভিযোগ নিরসনে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেছে- অন্তর্বর্তী সরকার দেশের যেকোনো সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতি শূন্য সহিষ্ণু নীতি গ্রহণ করেছে। অপরাধীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর যেভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজব ছড়ানো হয়েছে প্রকৃতপক্ষে সেভাবে কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কুমার সরকার। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশ গুজব ছড়িয়ে মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।’ গত ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্ট-চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটি আয়োজিত ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
চিন্ময়ের আন্দোলনের পেছনে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের হাত ছিল উল্লেখ করে বিজন কান্তি সরকার বলেন, ‘চট্টগ্রামে চিন্ময় হিন্দুদের দাবি দাওয়ার আন্দোলনের ডাক দিয়ে যেভাবে মাঠে নেমেছেন, এটির পেছনে আওয়ামী বিভিন্ন সংগঠন জড়িত ছিল। গোয়েদা সংস্থার লোকজন সেটি জানতে পেরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চিন্ময় কয়েকটি সমাবেশ ঘোষণা করলেও বেশিরভাগ সমাবেশ ফ্যাসিবাদের যেসব দোসর তাদের কমিটিতে ছিল, তারাই সব কর্মসূচি নির্ধারণ করে দিত। তাদের পুনর্বাসনের জন্য পাশের দেশ ইন্ধন যুগিয়েছিল।’
সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে অনেক তথ্যই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে মন্তব্য করে বিজন কান্তি সরকার বলেন, ‘ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যে পরিমাণ নির্যাতনের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে তার সিকি ভাগও ঘটেনি। তারপরও মানুষ রাস্তায় নেমে মিছিল করেছে, প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু আমরা যখন সেখানে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলি, তারা আমাদের জানিয়েছে, তারা শুনতে পাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় হামলা হচ্ছে, নির্যাতন হচ্ছে, তাই তারাও মাঠে নেমেছেন।’
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কুমার সরকার বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের বদনাম ছিল তারা সবসময় আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের ভোট দেয়। আগে তারা আমাদের পদায়ন করত না, কিন্তু গত কিছু সময় থেকে তারা প্রতিটা নিয়োগে হিন্দুদের ভালো ভালো জায়গায় পদায়ন করেছে, শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন পাওয়ার জন্য। তাদের বুঝানোর জন্য যে, তারা সবসময় সংখ্যালঘুদের পাশে ছিল।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায়ের অপচেষ্টা করছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক সহিংসতাকে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে উপস্থাপন করে একটি বিভ্রান্তিকর আখ্যান তৈরির চেষ্টা করছে তারা। ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা প্রচার করছে। এর মাধ্যমে মূলত দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। এসব প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজর কাড়তে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি ভ্রান্ত চিত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই অপচেষ্টা উদ্দেশ্যমূলক এবং গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।
এই অপপ্রচারের মূল উদ্দেশ্য হলো এক. বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট করে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দেশ হিসেবে চিত্রিত করে বিশ্ববাসীর কাছে ছোট করা। দুই. রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পেয়ে ক্ষমতায় ফেরা। তিন. দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে অস্থিতিশীলতা বাড়ানো।
বিশেষজ্ঞদের মত এসব অপপ্রচারের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের উচিত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং সংস্থাগুলোর সাথে সরাসরি যোগাযোগ বাড়াতে হবে সরকারকে। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈদেশিক মিশনগুলোকে আরো বেশি সক্রিয় করে তুলতে হবে। মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ পাল্টা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে সচেতন করতে হবে।
কেকে/এমএস