সম্প্রতি দেশের কয়েকটি সীমান্তের শূন্যরেখায় ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর (বিএসএফ) কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বিরাজ করছে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে। ইতোমধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কঠোর অবস্থানে বেড়া নির্মাণ বন্ধ রেখেছে বিএসএফ। একইসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে উদ্বেগ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আর নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নয়। সীমান্ত ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আর ছাড় দেবে না বাংলাদেশ। এমনটাই উঠে এসেছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কথায়। তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় সীমান্তে বেড়া দেওয়া নিয়ে যেসব অসম সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, সেগুলো বাতিলের বিষয়ে পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ তিনি জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমানা নির্ধারণ ও উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব পালনসংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত মোট চারটি চুক্তি আছে। বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম সীমান্ত নির্দেশাবলি-১৯৭৫ অনুযায়ী উভয় দেশের শূন্যরেখা ১৫০ গজের মধ্যে প্রতিরক্ষা সামর্থ্যতা-সংবলিত যে কোনো কাজ সম্পন্নের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া উভয় দেশের প্রয়োজনে শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্নের ক্ষেত্রে একে অপরের সম্মতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সম্প্রতি সীমান্তের পাঁচটি জায়গায় ভারত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ শুরু করেছে। বিজিবি ও স্থানীয় লোকজনের শক্ত অবস্থানের কারণে ভারত ওইসব স্থানে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বিজিবির সঙ্গে একজোট হয়ে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার প্রতিবাদ করায় তিনি সীমান্তবর্তী জেলার অধিবাসীদের ধন্যবাদ জানান।
সীমান্ত ইস্যুতে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানে বিচলিত ভারতীয় রাজনীতিকরা। তাদের অভিযোগ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বাধা দিয়ে বাংলাদেশ যুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টা করছে। এমন দাবি করে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিমন্ত্রী শোভন দেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান সরকার পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টা করছে। সীমান্তে বাংলাদেশ ভারতকে কাঁটাতারের বেড়া দিতে দিচ্ছে না। তিনি আরো দাবি করেন, বাংলাদেশের ঘটনায় কিছু কিছু দেশের ইন্ধন আছে বলে তার মনে হয়।’
দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘ভারতকে আমরা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি যে আমরা ভালো সম্পর্ক চাই, দুপক্ষেরই স্বার্থের ভিত্তিতে। আমরা সব দেশের সঙ্গেও সুসম্পর্ক চাই, সম্মানের ভিত্তিতে সমতার ভিত্তিতে। সে লক্ষ্যেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
এদিকে গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ‘দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ভারতের বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবি সহযোগিতার মাধ্যমে সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে কাজ করবে। আমি পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনা করেছি। অপরাধমুক্ত সীমান্ত নিশ্চিতের ব্যাপারে ভারতের প্রত্যয় নিয়ে কথা বলেছি।’
জানা যায়, ভারতের দিক থেকে নতুন সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন এবং একই সঙ্গে নজরদারির জন্য একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সঙ্গে প্রহরীদের সতর্ক করার জন্যও কিছু যন্ত্র লাগানো হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। নতুন এ সমন্বিত ব্যবস্থাপনাকে বিএসএফ বলছে ‘ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স অ্যাট ভালনারাবেল প্যাচেস-ইএসভিপি’ বা ‘অসুরক্ষিত এলাকাগুলির জন্য বৈদ্যুতিক নজরদারি’ ব্যবস্থা।
যেসব স্থানে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করছে বিএসএফ তার কয়েকটি জিরো লাইন থেকে দেড়শ গজের ভেতরে হওয়াতেই আপত্তি করছে বাংলাদেশের বিজিবি। আবার যেখানে নদী বা অন্য কোনো কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সুযোগ নেই সেখানে নজরদারির জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাসহ বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে তিন দিন ধরে উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যার কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে সীমান্তের ১২০০ গজের মতো অংশে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না এবং সেই বেড়া তৈরির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০ গজ ভেতরে মাটি খোঁড়া হচ্ছিল বলে বিজিবি জানিয়েছে। বাংলাদেশের তীব্র আপত্তির মুখে বিএসএফ কাজটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
গত সপ্তাহে লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের বৈদ্যুতিক পিলার ও যন্ত্র স্থাপনও বন্ধ করে দিয়েছে বিজিবি। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে রাতের অন্ধকারে বিএসএফের সদস্যরা সীমান্তের শূন্যরেখার মধ্যে লোহার বৈদ্যুতিক খুঁটি ও অজানা একটি যন্ত্র স্থাপনের চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় পতাকা বৈঠকে প্রতিবাদ জানায় বিজিবি। এরপরই বন্ধ হয়ে যায় পিলার স্থাপনের কাজ। বিজিবি ও স্থানীয়রা জানায়, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের প্রধান পিলার ৮২৯ নম্বরের ২ নম্বর উপপিলার পাটগ্রাম সদর ইউনিয়নের গাটিয়ারভিটা সীমান্তের শূন্যরেখার ৫০ গজ অভ্যন্তরে রাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার বিএসএফের ৯৮ ব্যাটালিয়নের ফুলকাডাবরী ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা সে দেশের নির্মাণ শ্রমিকদের নিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও যন্ত্র স্থাপন করে। পরদিন ঘটনাস্থলে গিয়ে কৃষকরা বিষয়টি দেখতে পেয়ে বিজিবিকে খবর দেয়। বিজিবি বিএসএফের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত বৈদ্যুতিক খুঁটি ও যন্ত্র সরিয়ে নিতে বলে এবং পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয়। পরে ওই সীমান্ত পয়েন্টে বিএসএফ-বিজিবির মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কোনোকিছু না জানিয়ে শূন্যরেখার মধ্যে খুঁটি ও যন্ত্র স্থাপন করার প্রতিবাদ জানায় বিজিবি। নির্মিত খুঁটি ও যন্ত্র সরিয়ে নিতে আহ্বান জানালে স্থাপিত যন্ত্র ও খুঁটি সরিয়ে নেয় বিএসএফ।
এ ছাড়া নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার বস্তাবর সীমান্তে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করেবিএসএফ। বিজিবির বাধায় কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় বিএসএফ। বর্তমানে সেখানে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন নওগাঁ-১৪ বিজিবির অধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। তিনি জানান, বিএসএফ সদস্যরা আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে কাঁটাতারের বেড়া দিতে আসার খবর পেয়ে বিজিবি সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। এ সময় কাজ না করেই ফিরে যায় ভারতীয়রা।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার। যার ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে ভারত। এক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক কোনো আইনের তোয়াক্কা করেনি। এমনকি আইন অনুযায়ী বিজিবিকে অবহিত করারও প্রয়োজন দেখায়নি। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু নীতির কারণে ভারত সীমান্তে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল। এমনকি সীমান্ত এলাকায় গুলি করে নির্বাচারে বাংলাদেশি হত্যা করতেও পিছপা হয়নি বিএসএফ। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণসহ অবৈধ স্থানপনা নির্মাণ, গুলি করে বাংলাদেশি হত্যার ঘটনায় কখনো আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়নি। তবে পরিস্থিতি বদলে যায় গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সেদিন ভারতের পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের শাসনের। পরে বিদায়ী বছরের ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার শেখ হাসিনার নতজানু নীতির প্রত্যাখ্যান করে আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকে জোর দেয়। সীমান্তে ভারতের আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। বদলে যায় সীমান্তের পরিস্থিতি।
কেকে/এমএস