সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে আরো আগে। সে অবনতি এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে তৈরি অসন্তোষ পৌঁছে গেছে দুদেশের রাজধানীতে। পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ঢাকা ও দিল্লি।
সীমান্তের শূন্যরেখায় বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করলে বাধা দেয় বিজিবি ও স্থানীয়রা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে উদ্বেগ জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর একদিন পরই পাল্টা পদক্ষেপ নেয় ভারত। গতকাল সোমবার দিল্লিতে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার নুরুল ইসলামকে তলব করে দেশটির কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে উভয় দেশের কূটনৈতিক মহলে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে একাধিক সহিংস ঘটনাও ঘটেছে। সীমান্ত এলাকায় গুলি ও সংঘর্ষে এসব ঘটনা প্রভাবিত করছে সাধারণ মানুষের জীবনকে। বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিজিবি) এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) মধ্যে অঘোষিত সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এ উত্তেজনা দেখা দেয়।
সূত্রে জানায় সীমান্তে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান এবং গুলি চালানোর মতো ঘটনাগুলো উত্তেজনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর এসব ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে সীমান্তে সহিংসতা বন্ধ এবং উভয় দেশের যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। এরপরই ভারত দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার নুরুল ইসলামকে তলব করে। ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের এ পদক্ষেপ মূলত বাংলাদেশের উদ্বেগের প্রতি জবাব।
এদিকে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সীমান্ত সমস্যা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের পুরোনো ইস্যু। তবে কূটনৈতিক স্তরে এমন তলব-পাল্টা তলব সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষায় সংলাপই একমাত্র সমাধান।
তারা আরো মনে করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সীমান্ত সমস্যা একটি সংবেদনশীল ইস্যু, যা দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা বাড়ানোর মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।
অন্যদিকে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিদ্বেষ কারো জন্যই ভালো নয় বলে মন্তব্য করে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ হলো আরেকটি দেশ, যাদের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত আছে। আমরা প্রতিবেশী, আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে, পরস্পরকে বুঝতে হবে। কোনো ধরনের বিদ্বেষ আমাদের কারো স্বার্থের জন্যই ভালো হবে না।’ গতকাল সোমবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
এ ছাড়া ভারত-বাংলাদেশের এ ইস্যুতে সরব দেশের রাজনৈতিক নেতারাও। বাংলাদেশের সীমান্তের ১৬০ জায়গায় ভারতের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন ‘শেখ হাসিনা সুবিধা দেওয়ার কারণে আমাদের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে ১৬০ জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে।’ রিজভী বলেন, ‘শেখ হাসিনা ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যেভাবে ভারতকে যে সুবিধা দিয়েছে, সে সুবিধার কারণে আপনার অসম যে কাজগুলো করেছে, যেটা দুটি স্বাধীন দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে করা যায়, সেটা না করে জোর করে কাঁটাতারের বেড়া লাগিয়েছে।’
ভারত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান কিংবা দুই দেশের মধ্যে চুক্তিগুলোও মানছে না অভিযোগ করে এ বিএনপি নেতা বলেন, ‘শূন্য রেখা থেকে ১৫০ গজ সীমানার মধ্যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা হবে না। হতে গেলেও দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। সেটাও না মেনে তারা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জায়গায়।’
ভারত-বাংলাদেশের চলমান সংকট দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি করছে কিনা এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ও অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন খোলা কাগজকে বলেন, ‘কাঁটাতারের বেড়ার বিষয়টি ভারত একমত হয়েছিল যে, তারা স্থগিত করবে। কিন্তু এটা তো তারা করছে না। যেহেতু দুই দেশের সম্পর্ক এ মুহূর্তে একটা নতুন বাস্তবতার মধ্যে আছে; এখানে দুপক্ষই মনে করে, তাদের পারস্পরিক যে আস্থা সেটা প্রতিষ্ঠা করা খুব জরুরি। সেক্ষেত্রে ভারতের একটা ভূমিকা দরকার, কারণ ভারত বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও বোঝাপড়া গুরুত্বপূর্ণ। যেটা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা’।
চলমান এ সমস্যার পেছনে ‘দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের অনীহা’ রয়েছে মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে, এক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব না দেওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব ব্যাপক। ফলে বিষয়টি সাময়িক উত্তেজনার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার ও সীমান্তে বিএসএফের নানা সহিংসতা বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ভারতের মিডিয়ার যে নেতিবাচক ভূমিকা দেখলাম; এখনো দেখছি, এটা বাংলাদেশকে নিয়ে ভিন্ন একটি ভাবমূর্তি তৈরির অপচেষ্টা। এটি সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। আমি মনে করি ভারতীয় মিডিয়া এবং তাদের সীমান্তের দায়িত্বশীলদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার অভাব আছে। যা সার্বিক বিষয়টি জটিলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খোলা কাগজকে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, এটা অস্বীকার করলে চলবে না। এখন বিষয়টি হয়তো স্বাভাবিককরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। দুই দেশের তলবের মধ্যে সম্পর্ক কতটা স্বাভাবিক হবে এটা দেখার দরকার। কারণ, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটছে, যার ফলে তলব করা হচ্ছে। ’
পাল্টাপাল্টি তলবের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ তলব করার পর ভারত হয়তো ভাবছে একতরফা তলব হয়ে যাচ্ছে। তাই হয়তো তাদের দেশের জনগণকে দেখানোর জন্যই তারাও পাল্টা তলব করেছেন। তবে আমাদের দেখতে হবে কীভাবে বিষয়টি সমাধান ও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করা যায়। যদিও তারা বলছে সম্পর্ক ভালো আছে। এখন দেখার বাকি, পাল্টাপাল্টি তলবের মধ্যেই এটি হবে কিনা।’
কেকে/এমএস