ছাত্র-জনতার তোপের মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। অথচ তার জন্য সাড়ে ১৫ বছর জিম্মি ছিল পুরো দেশ। এবার হাসিনার পতনের ধাক্কা লেগেছে তার ভাগ্নি যুক্তরাজ্যের সিটি মন্ত্রী (সাবেক) টিউলিপ সিদ্দিকের জীবনে। মন্ত্রিত্ব গেল টিউলিপের।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের নানান অনিয়ম-দুর্নীতির দায় মাথায় শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন তিনি। মূলত হাসিনার পতনেই টিউলিপের আজকের এ অবস্থা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘শেখ হাসিনার পতন না হলে তার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপকে পদত্যাগ করতে হতো না। টিউলিপকে এত বিতর্কের মুখে পড়তে হতো না। ৫ আগস্টের পর শেখ পরিবারের অপকর্ম প্রকাশ্যে এসেছে। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান ও ক্ষমতার স্বাদ একাই নিয়েছেন। এ নিয়ে যেন কারোর মধ্যে কোনো রাগঢাক না থাকে তাই তিনি পরিবারের অন্য সবাইকে সীমাহীন অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন। অন্যদের মতো টিউলিপও বহু অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। যা শেষ পর্যন্ত তার জন্য কাল হলো।’
টিউলিপ সিদ্দিকের দুর্নীতির অভিযোগে নাম আসায় যাকে নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তোলপাড় চলছিল যুক্তরাজ্যে। সমালোচনার মুখে ব্রিটেনের আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) ইস্তফা দেন ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ। এর মধ্যে দিয়ে চারবারের এই লেবার এমপির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও হুমকির মুখে পড়ল।
গত অগাস্টের পর থেকে ঢাকায় শতাধিক মামলা হয়েছে শেখ হাসিনার নামে। কখনও হত্যা মামলায় তার নাম এসেছে, কখনো আবার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
ঢাকায় এসব তদন্তের মধ্যেই হঠাৎ টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ৫ বিলিয়ন ডলার দুর্নীতির অভিযোগে শেখ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নাম আসে ব্রিটেনের আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৭ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানা ও তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানায়। সেই থেকে যুক্তরাজ্যেও খবরের শিরোনামে আসতে থাকেন উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট আসনের এমপি টিউলিপ, যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত।
ঢাকার পাশাপাশি যুক্তরাজ্যেও টিউলিপের ‘দুর্নীতি ও অনিয়মে’ জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে। এমনকি তার বিনা টিকেটে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাওয়ার খবরও আসতে থাকে সংবাদমাধ্যমে।
পরিস্থিতি জটিল করে তোলে লন্ডনের কয়েকটি বাড়ি, যেগুলো টিউলিপ এবং তার পরিবারের সদস্যদের উপহার দেওয়া হয়েছে কিংবা বিনা পয়সায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। আর সেগুলো তাদের দিয়েছেন ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা, যাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার যোগ আছে।
এসব নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তুমুল সমালোচনা চলছিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে, টিউলিপের ওপর বাড়ছিল পদত্যাগের চাপ।
বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি যেমন তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে, একটি পত্রিকায় রীতিমত সম্পাদকীয় লিখে তাকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেয়। প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়া হয় তাকে বরখাস্ত করার। দুর্নীতিবিরোধী একটি জোটও তাতে কণ্ঠ মেলায়।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসও তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তদন্তে যদি প্রমাণ হয় যে টিউলিপ এসব ‘ডাকাতি'র সুবিধাভোগী, তাহলে সম্পত্তিগুলো ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
টিউলিপকে ক্ষমা চাইতে ও পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, তিনি দুর্নীতি দমনবিষয়ক মন্ত্রী হয়েছেন এবং নিজেকে এখন নির্দোষ দাবি করছেন।
এ নিয়ে তর্ক-বির্তক আর সমালোচনার মধ্যে স্টারমারের মন্ত্রিসভা থেকে তার পদত্যাগের খবর এল।
কেকে/এআর