বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। শীতকাল এলেই একটি ভিন্ন আবহে মেতে ওঠে। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই জেলা শীতের তীব্রতা, প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রূপ, এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসবের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
প্রতিবছর শীতকালে পঞ্চগড় দেশের সবচেয়ে শীতলতম স্থান হিসেবে রেকর্ড করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এই বছরের জানুয়ারিতে তেঁতুলিয়ায় ৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বনিম্ন।
পঞ্চগড়ের শীতকে শুধু ঠান্ডা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এটি সঙ্গে করে আনে ঘন কুয়াশা, শৈত্যপ্রবাহ, এবং হিমেল হাওয়া। দিনের অধিকাংশ সময় সূর্যের মুখ দেখা যায় না। শীতের প্রকোপে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ভোগেন। সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়ার মতো শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে।
গ্রামাঞ্চলে শীত নিবারণের অন্যতম মাধ্যম হলো খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহানো। শীতবস্ত্রের অভাবে অনেক মানুষ চরম কষ্টে দিন পার করেন। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য শীতকাল একটা সংগ্রামের সময় হয়ে দাঁড়ায়।
পঞ্চগড়ের অর্থনীতিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শীতকালের ঠান্ডা আবহাওয়া চা চাষের জন্য আদর্শ। এখানকার চা বাগানগুলোতে এ সময় ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা কম থাকায় আলু, সরিষা, ও ধানের চাষেও শীতের প্রভাব পড়ে।
ঘন কুয়াশার কারণে অনেক সময় ফসলের বৃদ্ধি ধীর হয়। কনকনে ঠান্ডার কারণে দিন ছোট হয়ে যায়, ফলে কৃষকেরা দিনের কাজ সময় মতো শেষ করতে পারেন না। তবে শীতকালীন সবজি উৎপাদন এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙা রাখে।
পঞ্চগড়ের শীতকাল শুধু শীতলতা নয়, বরং প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্যের এক মহোৎসব। তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চোখধাঁধানো দৃশ্য পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। পাশাপাশি এখানকার চা বাগান, নদী, এবং গ্রামীণ দৃশ্য মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা দেয়।
শীতকালে পঞ্চগড়ে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যায়। পর্যটকরা তেঁতুলিয়া, মহানন্দা নদীর তীর, এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘুরে দেখেন। গ্রামের মাটির ঘর আর কুয়াশার চাদরে ঢাকা সবুজ প্রান্তর এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
পঞ্চগড়ের শীতের অন্যতম বড় আকর্ষণ হলো পিঠা। গ্রামীণ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায় এই সময়ে। পাটিসাপটা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ পিঠা, আর খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি মজাদার খাবার শীতের বিশেষ উপভোগ্য অংশ।
গ্রামাঞ্চলে পিঠা উৎসবের আয়োজন হয়, যেখানে পরিবার ও প্রতিবেশীরা একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। হাট-বাজারেও পিঠার দোকানের ভিড় লেগে থাকে। শীতের রাতে আগুন পোহানোর সময় পিঠা খাওয়া যেন শীতের আমেজকে আরও আনন্দময় করে তোলে।
শীতার্তদের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে এই সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শীতকালীন সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে তারা শীতের প্রকোপ থেকে কিছুটা রক্ষা পায়।
বেসরকারি সংস্থাগুলোও শীতার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ বিতরণ করছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এই উদ্যোগ অনেক সময়ই অপ্রতুল হয়ে পড়ে।
পঞ্চগড়ের শীত এখানকার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এটি যেমন মানুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, তেমনি প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। সঠিক প্রস্তুতি ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শীতের তীব্রতা মোকাবিলা করা সম্ভব। একই সঙ্গে শীতের এই সময়টিকে সৌন্দর্য, উৎসব, এবং ঐতিহ্যের মাধ্যমে উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। পঞ্চগড়ের শীত শুধু ঠান্ডা নয়, এটি একটি অনুভূতি, যা মানুষের হৃদয়ে স্মৃতি হিসেবে বেঁচে থাকে।
কেকে/এএম