জুলাই ঘোষণা ২০২৪-এর জন্য বহু বিষয় নিয়ে আমাদের সবাইকেই অবিলম্বে ভাবতে এবং বুঝতে হবে, পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সর্বসম্মত সাধারণ অবস্থান গ্রহণ ও বাস্তবায়ন খুব বড় কাজ। জনগণকে সচেতন করা এবং আগামীতে বড় রূপান্তরের জন্য তৈরি করে তোলা এখনকার খুবই দরকারি কাজ। আসুন, আলোচনায় অংশগ্রহণ করুন এবং আপনার ভাবনা জানান।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল সব ধরনের ফ্যাসিবাদ, গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে জনগণের বিজয় অর্জন এবং গণসার্বভৌমত্ব কায়েম। অর্থাৎ জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় বাস্তবায়ন। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে গণসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নতুন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ গঠন। অতএব, জুলাই গণভ্যুত্থানের পর আমাদের সব চিন্তা ও পরিকল্পনা গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের আলোকে অর্থাৎ খোদ জনগণকেই কীভাবে আমরা ক্ষমতাসম্পন্ন করে তুলতে পারি সে আলোকেই সাজাতে হবে।
১. আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ এবং ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন এবং তা আরোপ ও বাস্তবায়নের কোনো ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকবে না যেন ফ্যাসিবাদের সব রূপের পূর্ণ বিলোপ আমরা ঘটাতে পারি।
২. আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই যার ভূমিকা হবে প্রাণের আবাস ও প্রাণের বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস হয় এমন কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন এবং তা আরোপ ও বাস্তবায়নের কোনো ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকবে না এবং জমি, বন, পানি, নদী, জলাশয় ও সমুদ্রের ওপর জনগণের অধিকার বা হক কায়েম হবে। আমাদের বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমি, পাহাড়, নদী, জলাশয়, হাওর, বাওর, খালসহ সব খাস সম্পত্তি অবলিম্বে উদ্ধার করা হবে এবং তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদসহ সব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জনগণের পূর্ণ অধিকার ও মালিকানা কায়েম করা হবে। জনগণের সামষ্টিক স্বার্থের সঙ্গে বিরোধাত্মক কোনো আইন বা নীতি রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে না।
৩. তিন বিশাল নদীর মোহনায় এ নদীমাতৃক ভূগোল ও বঙ্গোপসাগরের কোলে গড়ে ওঠা উর্বর ভূগোল ও জনপদের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হবে প্রাণবৈচিত্র্যভিত্তিক কৃষি। বাংলাদেশ মিষ্টি পানিতে সমৃদ্ধ দেশ। অবিলম্বে সব প্রকার বিষ, ক্ষতিকর ও প্রাণঘাতী রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে এবং একর প্রতি উৎপাদনশীলতা দ্রুত বৃদ্ধি করা হবে, যেন কৃষি শিল্প্যনের ইঞ্জিন এবং সুস্থ মানবসম্পদ তৈরিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। সুজলা সুফলা শ্যামল বাংলাকে আবার অপরূপ রূপে সাজিয়ে তার সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে বিশ্বের আকর্ষণীয় নজির হিশাবে গড়ে তোলা হবে।
৪. আমরা রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই না। বসবাসের অযোগ্য ঢাকা শহর ভাঙতে হবে। আমরা চাই কলোনিয়াল প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তে বিকন্দ্রীকৃত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো ভাগ হবে ভূগোল, প্রাণ ও প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যেন প্রতিটি অঞ্চল তাদের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট অনুযায়ী পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে। বাংলাদেশিকে সারা বিশ্বের নাগরিকদের কাছে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় দেশ হিশাবে গড়ে তুলতে হবে।
৫. বৈরী আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের অবিলম্বে শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমরা চাই সব নাগরিকের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা এবং সামরিক শিক্ষা ও প্রযুক্তি সব দিক থেকে শক্তিশালী সেনাবাহিনী, যেন আমরা হামলার উপযুক্ত জবাব দিতে পারি। অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে জনগণের বিপরীতে এবং জনগণকে সেনাবাহিনীর বিপরীতে দাঁড় করাবার পুরোনো নীতির অবসান ঘটাতে হবে, যার দ্বারা সেনাবাহিনীকে জনগণের নয়, লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির লুটপাটের পাহারাদারে পরিণত করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি নাগরিকই সৈনিক এবং প্রতিটি সৈনিকই নাগরিক এ নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশে আমরা শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই।
৬. গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশ এবং জাতীয় উন্নতি নিশ্চিত করা। অবিলম্বে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং অল্প কিছু দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে চলমান অবাধ বাজার ব্যবস্থার নীতির অবসান ঘটাতে হবে। ব্যবসায়ী ও লুটেরা ব্যাংক চক্রের বাইরে আমাদের দরকার বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থামুখী অর্থনীতি, যেন শক্তিশালী উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীর বিকাশ এবং তরুণদের কর্মসংস্থান এবং কৃৎকৌশল আত্মীকরণ সহজ হয়।
৭. আমরা পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ক্ষমতা কাঠামো ভেঙে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ক্ষেত্রে নারীর নেতৃত্বের বিকাশ চাই। শ্রমিক, কৃষক, তাঁতী, জেলেসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং অবহেলিত জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি ও পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
৮. আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই যেখানে ‘সংখ্যালঘু’ হিশাবে নয়, প্রত্যেকেই পূর্ণ নাগরিক ও মানবিক মর্যাদায় শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশ আমাদের সবার আবাস, আমাদের সবার দেশ, আমাদের সবার গৌরব এবং সবার পরিচয় হিসেবে পরস্পরকে শক্তিশালী আত্মীয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করবে।
কেকে/এএম