মনির এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। রেজাল্ট বেরুবে দুই মাস পর। এ সময় কী করবে সে। সারাদিন ফেসবুক দেখে কীভাবে সময় কাটানো যায়। মনির বই পড়তে ভালোবাসে। সে দূরে কোথাও গেলে সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভুতিভূষণ, শরৎচন্দ্র বা নজরুলের বই সঙ্গী করে। সাম্প্রতিক কালে টিভিতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখে দেখে উনারও ভক্ত হয়ে গেছে। হুমায়ূনের বইও তার পছন্দের তালিকায় রয়েছে। হঠাৎ সেদিন ছোট চাচা ডাকতে ডাকতে পড়ার ঘরে গিয়ে দেখে মনির হুমায়ুন আজাদের ‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল’ বইটি পড়তেছিল। চাচাও অবাক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ছুটিতে বাড়ি আসছেন। উনার নাম সবুজ। সবুজ চাচা মনিরকে খুব ভালোবাসে। তার বই পড়ার প্রতি আগ্রহের কারণে চাচা মাঝে মাঝে তাকে বই কেনার টাকাও দেয়। কিন্তু এতোদিন রবীন্দ্র-নজরুল পড়তে ছিল এখন আবার হুমায়ুন আজাদে আসাতে চাচা মনে মনে খুশি হয়েছে। তিনিও স্কুলে পড়ার সময় হুমায়ুন আজাদের,‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, ‘লাল নীল দীপাবলি’ ও অন্যন্যা বই পড়েছেন। সবুজ চাচা মনিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, চল কোথাও একটু ঘুরে আসি। দুইদিন হয়ে গেলো। একা একা ঘুরে মজা লাগে না। আমার বন্ধুরাও এখন কেউ গ্রামে নেই। সবাই পড়াশোনায় নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। আগে এখানেও কয়েকজন ছিল তারা নিজ নিজ ব্যবসা বানিজ্য বা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত।
- তোমার একজন বন্ধুও এখন নেই? আফসোস। তাহলে চলো আমার বন্ধুদের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। আমার বন্ধুরা তো সব হাফপ্যন্ট পড়া। তাদের সাথে তোমার ঘুরতে ভালো লাগবে চাচা।
- ইয়ারকি করতেছো? দেখাচ্ছি মজা বলেই হাত তুলতেই মনির দেয় এক দৌড়।
চাচা হাসতে হাসতে খুন। দাঁড়া দাঁড়া বলে চাচাও এক দৌড়ে মনিরকে ধরে ফেলে।
দুজনের বয়সের ব্যবধান চার বছরের। তবু চাচা মনির সাথে অনেক কথা শেয়ার করে। ঢাকার অনেক গল্প করে মনিরের কাছে। বলল জানিস, সেদিন ভূতের গলিতে গিয়ে ছিলাম।
ভূতের গলি? ঢাকায় ভূতের গলিও আছে? বলো কী।
- হ্যা রে। ভূতের গলি। আমিও প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু সত্যি সত্যি ভূতের গলি যে আছে রে ভাতিজা। তুই কখনো ঢাকায় গেলে তোকেও নিয়ে যাবো।
- না না বাবা। আমার ভূতের গলিতে যাওয়ার দরকার নেই। ভূত যে কখন ঘাড় মটকে দেয় তার কোনো গ্যারান্টি আছে। মনিরের কথায় সবুজ চাচা হেসেই খুন।
- আরে বোকা ভূত কোনো কালে থাকলেও এখন আর নেই। আমি দুই বছর থেকে ঐ গলিতে যাওয়া আসা করি। কখনও বন্ধুর বাসায় যেতে হলে ভূতের গলি হয়ে যেতে হয়। কিংবা কোনো দরকারে।
- বাহ বাহ। তোমার তো সাহস আছে বটে।
- কেন রে। এটা এমন কি সাহসের হলো। কত মানুষই তো সেখানে বাস করে, কেউ বা ব্যবসা বানিজ্য করে। কই কখনো তো ভূতের ব্যাপারে কিছু শুনিনি।
- ভূত দেখেছে এমন কাউকে কি পেয়েছো চাচা। যিনি ভূতের সাথে দেখা হয়েছে, ভূত তাকে গাছের আগায় নিয়ে তুলে রেখেছে বা পুকুরের মাঝ খানে নিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে। কিংবা অন্য কোনো ঘটনা?
- হা হা হা করে চাচা এক গাল হাসি হেসে মনিরকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওখানে দিনে রাতে শত শত মানুষ নানা কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভূত আসবে কি ভাবে?
- আসবে আসবে। ভূতের আগুন চোখ দেখেছো চাচা? টিভিতে এক নাটকে দেখেছি অন্ধকার রাতে শশ্বান ঘাটে অনেক ভূত। কোনোটা লুলা, কোনোটা খোড়া, কোনোটার আবার মাথা নেই। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলতেছে।
- ভূত তো অনেক রকম রয়েছে। মামদো ভূত, মেছোভূত, রামভূত, শশ্বান ভূত আর কত কী। চাচা তুমি ভূতের গল্প পড়োনি। পৃথিবীতে নাকি ভূত বলে কিছু নেই। একবার আমাদের বাংলার অজিত স্যার বলেছিলেন, তেতুল গাছ ও বট গাছ ভূতের খুব পছন্দ। সেজন্য রাতের বেলা কখনো যেন এই দুটো গাছের পাশ দিয়ে কেউ না যায়।
- এখন কি কোথাও বটগাছ ও তেতুল গাছ আছে যে, ভূত এসে বাসা বাঁধবে।
- তাহলে ভূত সাহেবরা কোথায় থাকে? তাদের ছেলে মেয়ে,নাতি নাতনি ওরাই বা কোথায় থাকে?
- থাকে না। ভূত সব মরে গেছে।
- ভূত মরে নাকি। কখনো তো শুনিনি। আমি শুনেছি রাতের আঁধারে কখনো কেউ ভূতের হাতে পড়লে সে মরে নাকি ভূত হয়ে যায়।
- আচ্ছা মনির তোর ছোট মামা কামালের খবর কী?
- কামাল মামা? আপনি খবর পাননি? কি আশ্চর্য।
- মনিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই সবুজ চাচা বলল, আরে আমি বাড়ি আসার কয়েকদিন আগে ভূতের গলিতে থাকা আমার বন্ধু রানার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম সন্ধ্যায়। তার কাছে আমার একটা নোট রয়ে গেছে অনেকদিন হলো। ভাবলাম হাতে কোন কাজ নেই। নোটটা নিয়ে আসি। সামনে তো আমার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি হাঁটতেছি হাঁটতেছি, পেছন থেকে আমাকে তোর কামাল মামা নাম ধরে ডাকতেছে। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি উনি আমার কাধে হাত রাখলেন। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। উনি অফিসের কি একটা কাজে গিয়েছেন। ভূতের গলির ২০৩ নম্বর বাড়িতে নাকি ঐ অফিস। আমিও সেই বাড়ির কাছাকাছি একটা বাড়িতে যাচ্ছি। অনেক কথা হলো। তাকে কেমন ফ্যাকাসে ফ্যাকাসে মনে হলো। একটা রোগা রোগা চেহারা। আমিও তো অনেক দিন পর দেখেছি। তার চোখ মুখ দেখলে কেমন জানি লাগে। আমি বললাম আপনি শুকিয়ে গেছেন কেন? তিনি কোন জবাব না দিয়ে তাড়াহুড়া করতেছিল। রাতের গাড়িতে নাকি চলে যাবে। কিছু হয়েছে নাকি তোর মামার?
- না। চাচার কথায় ভরকে গেলো মনির। মামার সাথে দেখা হয়েছে চাচার কেমন কথা। মনির চুপচাপ থেকে, নরম সুরে বলল, মামা তো বেশ কিছুদিন আগে...
- বলতে বলতেই সবুজ চাচা আবার বলল, বুঝছিস মনির তোর মামাকে চেনাই যাচ্ছে না। আমি অনেক সাধাসাধি করেও কিছু খাওয়াতে পারলাম না। তিনি কিছুই তো খাবেন না। অনেক বুঝালাম, ঢাকা এসে আত্মীয়ার সাথে দেখা হলো, আপ্যায়নের সুযোগ না দিলে কি হয়?
- মামাকে সত্যি কি আপনি দেখেছেন?
- এই আমাকে কি পাগল মনে হয়। আমি চিনব না তোর মামাকে। আমাদের বাড়িতে কতদিন আসছে বল তো।
- আসছে তো। মামা যখন বিয়ে করেনি তখন তো কদিন পর পর আসতো। আমার জন্মদিনে একবার কত বড় একটা কেক নিয়ে আসলো। তারপর আমার জন্য শার্ট প্যান্ট, স্কুল ব্যাগ। যাবার সময় তো জুতো কেনার জন্য পাঁচশ টাকাও দিয়ে গিয়েছিল।
- তখন তো তোর মামা তিন চারদিন থেকে গিয়েছিল। আমরা উনাকে নিয়ে তোর ফুফির বাড়িতে বেড়াতে গেলাম না? তোর মনে নেই?
- চাচ্ছু আমার সব কিছু মনে আছে। কিন্তু কামাল মামা তো...
- তোর মামার কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছে নাকি? তোর তোমার মামার কথা যখন থেকে শুরু করলাম তুই দেখি মাঝখানে মাঝখানে তোর মামার কথা বলতে চাইছিস। কী হয়েছে বল তো।
- তখন মনিরের চোখে জল ছলছল করতেছিল। যেন চোখের জলে ভাসিয়ে দেবে সবকিছু।
- চাচা কিছুটা অবাক হয়ে মনিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
- এই মনির হঠাৎ কি হলোরে তোর। বল না কি হয়েছে। তোর চোখেও পানি।
- কামাল মামা ম-রে গেছে বলে হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
- চাচা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো। মনিরের মা পাশের ঘর থেকে দৌঁড়ে এলেন। ঘরের আরো কয়েকজন। সবাই মনির কে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে।
- চাচার মুখ দিয়েও কোন কথা সরছে না। চুপচাপ তাকিয়ে আছে মনিরের দিকে। আর মনে মনে ভাবছে তাহলে ভূতের গলিতে যে দেখা হলো সেই কামালটা কে? নাকি ভূত হয়ে কামালের বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীতে তো তাহলে সত্যিই ভূত আছে।
কেকে/এএম