হ্যাঁ... আমি উন্মাদ! ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে।
বুকের ভিতরটা আনন্দে ভরে ওঠে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত এক দৃশ্য কল্পনা করি, উন্মাদের মতো একে ওকে মেরে বেড়াচ্ছি, আমাকেও মারছে মানুষ... ধাক্কা খাচ্ছি দেয়ালে, রক্ত ঝরছে... ওহ সে কী অপূর্ব দৃশ্য! হাতে একটা কুড়াল থাকলেও মন্দ হতো না! চিন্তা করে দেখুন তো, পাগলের হাতে কুড়াল থাকলে কী কী হতে পারে? ভয় পাচ্ছেন? আমার কিন্তু মজাই লাগে। যে শিকল দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে তার টুংটাং শব্দ আমার কাছে হার্পের শব্দের মতো মনে হয়... পাগলাগারদের ঘণ্টার সুর যে কী মধুর... তা বলে বোঝাতে পারব না! আহা, পাগলখানার মতো সুন্দর জায়গা আর হয় না।
জানেন, একটা সময়ে আমি পাগল হতে ভয় পেতাম! প্রতিদিন রাতে ঘুম ভেঙে যেত... ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম যেন উন্মাদ না হয়ে যাই! দীর্ঘকাল ধরে আমাদের বংশ এক অভিশাপ বয়ে চলেছে... প্রাচীনকালে নাকি কোনো এক অপার্থিব প্রেত দিয়েছিল সেই অভিশাপ। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে আমরা সবাই উন্মাদ হয়ে যাই, কথা বলতে পারি প্রেতলোকের বাসিন্দাদের সঙ্গে। পাগলামি মিশে আছে আমার রক্তে... অস্থি-মজ্জায়! ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রার্থনা করে কাটিয়ে দিতাম... ওই অভিশাপের হাত থেকে আমাকে বাঁচতেই হবে। রক্ষা করতে হবে এ অভিশপ্ত বংশকে। তখনই আমার শোবার ঘরের দৃশ্যপট বদলে যেতো... মনে হতো কোনো এক পুরোনো ঘরে চলে এসেছি, ফ্যাকাশে চেহারার একগাদা লোক এসে হাজির হয়েছে সেখানে। তারা ফিসফিসিয়ে কথা বলত, কানাকানি করতো... তারপর সবাই মিলে চাইতো আমার দিকে।
সুর করে ওরা একটানা বলে চলতো, “তুই-ও পাগল হবি... পাগল তোকে হতেই হবে! তুই হবি আমাদেরই একজন।”
ওরা আমার পূর্ব পুরুষদের প্রেত।
নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু শান্তির ঘুম আমার কপালে নেই... স্বপ্নেও হানা দিত সেই অশুভ প্রেতের দল! আমার দিকে তাকিয়ে হাসতো ওরা। ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসতাম... আর খেয়াল করতাম যে কালো কালো কিছু অদ্ভুত প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের কোনাগুলোতে... কেমন যেন ছায়া-ছায়া শরীর ওদের।
ফিসফিস করতো ওরা।
একটা সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠতো ওদের কথাগুলো, “তুইও মরবি... তো বাপের মতো! এই পুরোনো বাড়িটার বসার ঘরের মেঝেতে এখনো ওর রক্ত লেগে আছে! নিজের গলাতেই নিজে ক্ষুর চালিয়ে দিয়েছিল ব্যাটা... হা হা হা... তোকেও মরতে হবে!”
দুই কান চেপে ধরতাম, কিন্তু ওরা থামতো না।
হ্যাঁ! আমার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন... শুধু কি তাই? আমার ঠাকুরদাকেও একটা ঘরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো... নইলে উনিও অনেক আগে নিজেকে টুকরো টুকরো করে ফেলতেন।
তবে, উনারা একটা জিনিস বোঝেননি... যা আমি বুঝি! ওই প্রেতদের কথামতো চললে উন্মাদ হয়েও বেশ আরামেই বেঁচে থাকা যায়, যেমনটা আমি ছিলাম। দীর্ঘকাল কেউ বোঝেইনি যে আমি পাগল হয়ে গেছি।
আমি বেজায় ধূর্ত, কী বলেন?
হুট করেই এক রাতে প্রেতদের সাথে আমার বোঝাপড়া হয়ে গেলো। আমি হয়ে গেলাম উন্মাদ। কিন্তু লোকেরা কিছুই বুঝলো না। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতাম, আড্ডা দিতাম, পার্টিগুলোতে যেতাম... সুস্থ থাকার অভিনয় আরকি। একটা সময়ে সবগুলো পার্টি আমিই জমিয়ে তুলতে লাগলাম, বন্ধুরাও বেশ খুশি হলো। তবে হুটহাট উদ্ভট কিছু চিন্তা মাথায় এসে যেতো। যেমন— একবার এক পার্টিতে বসে খাচ্ছি, আমার পাশে বসে ছুরি দিয়ে কেক কাটছে আমার বন্ধু। হুট করেই মধ্যে হলো ছুরিটা ছিনিয়ে নিয়ে ওর বুক বরাবর বসিয়ে দিলে কেমন হয়? ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে! আহা... সে কী মধুর দৃশ্য!
অনেক কষ্টে সেদিন নিজেকে সামলেছিলাম।
এরপর বন্ধুদের মধ্যে ঝামেলা লাগাতে শুরু করলাম। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে বলে, বিরাট ভয়ংকর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিলাম! একটা সময়ে ওরা বুঝতে পারলো যে সব সমস্যার মূল আসলে ‘আমি’। কিন্তু কেউ কিছু বললো না... কারণ আমার তো অনেক টাকা, অনেক সম্পত্তি। ধনী লোককে কেউই তো বন্ধুবৃত্ত থেকে বের করে দিতে চায় না। তাই না?
টাকার ক্ষমতাই বড় ক্ষমতা।
তো, একদিন আমাদের সাথে আড্ডা দিতে এলো তিন ভাই। ওদের বংশ বেশ অভিজাত, কিন্তু এখন টাকা পয়সা খুব একটা নেই, বসতবাড়িটা ছাড়া জমি-জমাও তেমন নেই। কয়েকদিনের মধ্যে ওরা বুঝলো যে আমি বেশ টাকাওয়ালা। আমাকে ওদের বাড়িতে দাওয়াত করল, ওদের বাবাও বেশ খাতির করল আমাকে। খানিক পরেই বুঝতে পারলাম বুড়োটার উদ্দেশ্য... ওর একটা মেয়েও আছে। এই তাহলে ব্যাপার? আমার গলায় মেয়েকে ঝোলাতে চায়?
আমিও রাজি হয়ে গেলাম। হয়ে গেলো বিয়েটা। আমার তিন শ্যালক আর শ্বশুর অনেক খুশি! ওরা কি আর জানতো যে আমি আসলে উন্মাদ? আসলে ওই প্রেতরাই আমাকে বলেছিল বিয়েটা করতে।
একটা কথা বলি? আমার মাথা খারাপ, এটা জানলেও ওরা বিয়েটা দিত। কারণ আমার টাকা আছে! আর টাকা থাকলে সাত খুন মাফ।
নতুন বউ ঘরে এলো। কয়েকদিন পরই আমি বুঝতে পারলাম আমার স্ত্রী আসলে ভালোবাসে অন্য কাউকে! কালো চোখের এক যুবকের কথা নাকি ও মাঝে মাঝেই ঘুমের ঘোরে বলে... এই কথা কী করে জানলাম? প্রেতরা বলেছিল। তাহলে ও আমাকে কেন বিয়ে করল? নিজের বুড়ো বাপ আর ভাইদের অভাবের কথা ভেবে? বিয়ের পরেও প্রেমিকের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল মেয়েটা!
আমার স্ত্রীর চেহারা এখন আর মনে পড়ে না! ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ও বেশ সুন্দরী ছিল। ভাসা ভাসা চোখ, কোমর পর্যন্ত লম্বা ঘনো কালো চুল... আমার সাথে বিয়ের পর ওর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিলো। এখনো মাঝে মাঝে আমি দেখি ওকে... এই বদ্ধ ঘরের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার দিকে তাকায় না, ছোট্ট একটা জানালা রয়েছে, সেখান দিয়ে আকাশ দেখে। ও কি আমায় ঘৃণা করে? করাই উচিত।
ধীরে ধীরে আমার স্ত্রীর মুখটা আরো বেশি ফ্যাকাশে হয়ে এলো। মাঝে মাঝেই কাঁদত সে। ও আসলে আমাকে কখনোই পছন্দ করতে পারেনি। মাঝে মাঝে রাগ উঠত, হিংসা হতো সেই যুবককে... যাকে আমার স্ত্রী ভালোবাসে! আর ওর বাপ-ভাইরাও বদমাইশ, কেন আমাকে বললো না যে মেয়েটা অন্য কাউকে ভালোবাসে? কী ভেবেছিল? লুকিয়ে রাখবে? পারল লুকাতে? প্রেতরা তো ঠিকই বলে দিলো আমায়।
কিন্তু কী করা যায়? একটাই সমাধান... আমার স্ত্রীকে খুন করতে হবে!
ঠিক করলাম একদিন ওকে বাড়ির পাশটার হ্রদে ঘুরতে নিয়ে যাব, তারপর ধাক্কা মেরে ফেলে দেব... কিংবা ফায়ারপ্লেসে পুড়িয়ে মারব? নাকি ক্ষুর দিয়ে জবাই করে ফেলবো? ধরা পড়ে যাব যে! ধরা পড়ার ভয় আমার নেই... আমি এগুলো করিনি কারণ প্রেতরা রাজি ছিল না।
তারপর একরাতে শুয়ে আছি, তখনই একদল প্রেত এসে আমার কানে কানে বললো, “এই তো সময়, ক্ষুরটা বিঁধিয়ে দাও তোমার স্ত্রীর হৃৎপিণ্ড বরাবর!” ধীরে ধীরে উঠে বসলাম আমি, তারপর ড্রয়ার থেকে নিয়ে এলাম ক্ষুরটা। আমার বউ ঘুমে অচেতন। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে ও।
আস্তে করে হাতটা সরিয়ে দিলাম। ওর চোখে পানি। ঢং দেখে আর বাঁচি নাৃ ঘুমাতে গিয়েও প্রেমিকের জন্য কাঁদতে হয়। আরে, ওর ঠোঁটে কেমন যেন একটা হাসির আভাস? কাঁদতে কাঁদতে মানুষ আবার হাসেও? ও আচ্ছা প্রেমিককে নিয়ে হয়তো কোনো নোংরা সুখস্বপ্ন দেখছিল। ও কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরলাম, তারপর ক্ষুরটা তাক করলাম হৃৎপিণ্ড ববাবর...
তখনই জেগে উঠল আমার বউ! আমার হাতের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল সে... ধাক্কা মেরে আমায় সরিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিলো। পাথরের মতো জমে গেলাম আমি এ কী হয়ে গেলো? তবে কি আজ রাতে ওকে মারতে পারবো না?
আরে এ কী করছি আমি! ও দরজা খুলে বাইরে চলে যাবে তো!
তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে গলাটা টিপে ধরলাম! বেশ জোরে একবার চিৎকার দিলো কিন্তু ছাড়লাম না। আরো কয়েকবার আর্তনাদ করল ও তারপর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।
বেশ বেশ, এবার ক্ষুরটা বুকে চালিয়ে দিলেই হলো।
কিন্তু ওর চিৎকার শুনে বাড়ির চাকর-বাকরেরা জেগে উঠেছে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাচ্ছি আমি! তাড়াতাড়ি ক্ষুরটা ড্রয়ারে লুকিয়ে ফেললাম।
তারপর দরজা খুলে চেঁচাতে লাগলাম, “এই বাড়ির সব চাকরকে তাড়িয়ে দেব! আমার অসুস্থ বউটা এতোক্ষু ধরে চেঁচাচ্ছে, তোমাদের কোনো খোঁজ নেই!”
দুজন ঝি আর একটা চাকর মিলে আমার বউকে বিছানায় তুললো।
“আমার মুখ দেখতে এলে নাকি?” খানসামার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, “যাও ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসো!”
খানিক পরে এক ছোকরা ডাক্তার এলো, সে ভালো করে পরীক্ষা করল আমার স্ত্রীকে। এরপর তার পরামর্শে আরেকজন বয়স্ক ডাক্তারকে ডাকা হলো। দুজন মিলে বেশ ভালো করে পরীক্ষা করল আমার স্ত্রীকে। ততক্ষণে হুঁশ ফিরে গেছে শয়তানির...
দুই ডাক্তার মিলে পাশের ঘরে বেশ কিছুক্ষণ পরামর্শ করল। আমি দূরে দূরেই থাকলাম।
খানিক পরে বয়স্ক সেই ডাক্তার আমাকে দোতলার একটা নির্জন ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন।
“স্যার,” গম্ভীরমুখে বললেন তিনি, “আপনার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা আছে!”
“কেন?” অবাক হলাম! আমি নিজেই উন্মাদ আর আমার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা হয়ে গেলো?
“উনি মনে করেন যে আপনি উনাকে খুন করতে চান... গলাও নাকি টিপে ধরেছিলেন...”
“আরে..”
“নাহ, উনার গলায় তেমন চিহ্ন নেই!”
আনন্দে নেচে উঠলো মনটা। প্রেতরা আমাকে রক্ষা করেছে!
“যাই হোক, উনার খেয়াল রাখবেন? ঠিক আছে?”
“বেশ বেশ,” আমার মনে তখন অদ্ভুত এক খেয়াল এসেছে। বুড়ো ডাক্তার, খোলা জানালার একদম সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে কেমন হয়?
যাই হোক, এখন ওসব করা যাবে না।
এরপরের এক সপ্তাহ আমার স্ত্রী উদ্ভট সব আচরণ করতে লাগলো। চাকর আর ঝিদের দিকে থালা-বাসন ছুড়ে মারতো, একা একাই হাসতো... একদম ভেঙে পড়ল ওর শরীর। তবে আমাকে দেখলেই ভয়ে চুপ মেরে যেত মেয়েটা।
বাধ্য হয়ে আবার ডাক্তার ডাকলাম।
সবকিছু দেখে সেই বয়স্ক ডাক্তার বললেন, “অবস্থা খুব খারাপ, আপনার স্ত্রীর জন্য আলাদা একজন নার্সের ব্যবস্থা করতে হবে কাল থেকে।”
তার আর দরকার হলো না। পরের দিন সকালেই আমার স্ত্রী মারা গেলো।
আমরা সবাই মিলে ওকে কবর দিলাম। ওর বুড়ো বাপ একদমই কাঁদল না, তিনভাই অবশ্য খুব কাঁদল। আমিও খানিকটা কান্নার অভিনয় করলাম... সেই ক্ষুরটা কিন্তু আমার পকেটেই ছিল। নাহ, আমার কান্না মেকি নয়, ক্ষুরটা ওর বুকে বসাতে পারিনি সেই দুঃখে কাঁদছিলাম।
বাড়ি এসে একচোট হাসলাম অবশ্য। সবাই ভাবছে আমি বউকে অনেক ভালোবাসি!
যাই হোক, ভেবেছিলাম শয়তানিটা মরার পর একটু হলেও শান্তি পাব। কিন্তু তা তো আমার ভাগ্যে নেই! হুটহাট মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। খানসামাকে একদিন রাগ করে চড় মেরে বসলাম, রাস্তায় মানুষ দেখলেই মনে হতো ওদের ক্ষুর দিয়ে কোপাই!
আসলে তখন আরো বেশি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলাম।
উদ্ভট সব স্বপ্ন আসতে লাগলো ঘুমের মধ্যে। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম সেই পুরনো কালো প্রেতগুলো সাথে নতুন সাদা কয়েকটা প্রেত এসে হাজির হয়েছে। আমাকে দেখে হাসছে... ওরা কি আমায় নিয়ে গর্বিত? আমি উন্মাদ হলেও বেশ চালাক।
মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা একা একাই হাঁটতে বের হতে লাগলাম। একা থাকতাম না আসলে, আমি যেখানেই যেতাম প্রেতের দল আমার সাথে উড়ে উড়ে চলে আসতো। বেশ কয়েকটা পার্টিতেও গেলাম।
তো সে রকমই এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি আমার এক শ্যালক এসেছে। এই ব্যাটাকে বেজায় অপছন্দ আমায়, তিন ভাইয়ের মধ্যে এটা সবচেয়ে বেয়াদব।
“আরে, কী খবর তোমার?” হেসে বললাম আমি।
“এইতো, আপনার সাথে একটু কথা ছিল,” ওর মুখটা গম্ভীর।
“চলো টেবিলে গিয়ে বসি।”
এরপর খানসামাকে ডেকে চা দিতে বললাম। খানিকক্ষু সব চুপচাপ।
“আচ্ছা শুনুন,” বলতে শুরু করল ও, “শুনলাম আপনি আজকাল খুব পার্টিতে যান... মদও গেলেন প্রচুর। আমার বোনটা মারা যাওয়ার একটা বছরও হয়নি! এখন কি আপনাকে এসব মানায়? মেয়েটার স্মৃতির অপমান করছেন তো!”
ভিতর ভিতর রাগে জ্বলে উঠলাম আমি। এই ছোকরা এককালে সেনাবাহিনীর অফিসার ছিল, সেই গরম এখনো থেকে গেছে। অবশ্য আমার সাথে বোনের বিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ এরই ছিল, বাকি দুই ভাই খানিকটা আপত্তি করেছিল... তবে? এ কী আমার সম্পত্তি হাতাতে চাইতো নাকি? হয়তো এখনো ধান্দাতে আছে?
তখনই একটা প্রেত আমার কানে কানে বললো, “ভয় দেখা, ওকে ভয় দেখা!”
চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আমার। একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম শ্যালকের দিকে। কেমন যেন কুঁচকে গেলো ছোকরা।
ভয় পেয়েছে!
“বোনকে অনেক ভালোবাসতে, তাই না?” চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম আমি, “নাকি ওকে দিয়ে ফায়দা তুলতে চেয়েছিলে?”
“ম... মানে? কী বলতে চান আপনি?”
“কুত্তার বাচ্চা! আমাকে এতোই বোকা ভাবিস? তোর বোন অন্য কাউকে ভালোবাসতো... আর তুই ওকে জোর করে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছিস! যাতে করে আমার সম্পত্তি গিলে খেতে পারিস!”
লাফিয়ে উঠলো ছোকরা। তারপর একটা চেয়ার তুলে নিয়ে আমাকে মারতে এলো। আমিও এক লাফে সরে গেলাম।
ছোড়ার সাহস কত! আমার বাড়িতে ঢুকে আমাকেই মারতে চায়? ক্রোধে রীতিমতো অন্ধ হয়ে গেলাম!
“ওরে শয়তানের বাচ্চা, তোর বোনকে আমিই খুন করেছি,” লাফিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম, “আজ তোকেও মারবো, রক্ত চাই আমার... রক্ত!”
সরে গেলো ছোকরা, আমিও ঘুষি চালালাম... সেটা এড়াতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ও, আমিও টাল সামলাতে না পেরে পড়লাম ওর গায়ের ওপর, দুজন একসাথে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম আরকি।
আগেই বলেছি, ছোকরা সেনাবাহিনীতে ছিল। অন্য কেউ হলে ওর সাথে পেরে উঠতো না। কিন্তু আমি তো উন্মাদ! এমন এক উন্মাদ যার সাথে নরকের প্রেতরা আছে! একটু লড়াইয়ের পরেই ওর বুকে চেপে বসলাম... টিপে ধরলাম গলাটা... ছোকরা আর নড়তে পারছে না!
আরো জোরে চেপে ধরলাম আমি! জিভ বেরিয়ে এলো ওর, চোখদুটো যেন একটু হলেই ছিটকে বেরিয়ে আসবে...
তখনই ঘরে ঢুকল একদল লোক! ওরা কেন এলো? কী চায়?
আরে! হুট করে সবকিছু বদলে গেল!
আমি পড়ে আছি মেঝেতে আর ছোকরা বসে আছে আমার বুকের ওপর! লোকগুলো বলছে, “ছেড়ে দিন, উনাকে ছেড়ে দিন!”
সবকিছু পাল্টে গেলো কী করে? হয়তো এতেও প্রেতদের কারসাজি আছে! ছোকরা ছেড়ে দিলো আমায়। এক দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছলাম, তারপর নেমে পড়লাম রাস্তায়। সবাই জেনে গেছে যে আমি উন্মাদ... পালাতে হবে! এই শহর থেকে দূরে... বহু দূরে!
আমি দৌড়েই চললাম। কেউ বাঁধা দিলো না... পিছে তাকানোর সাহস নেই। কখনো কোনো বাড়ির ভিতর দিয়ে আবার কখনো লোকেদের উঠান দিয়ে এগিয়ে চললাম। একটা জলাভূমিতে তো প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু কোনোমতে বেঁচে গেলাম। আমার সাথে সাথে এগিয়ে চলেছে আঁধারের প্রেতরা। নরকে নিয়ে যেতে চায় নাকি?
পিছন থেকে ভেসে আসছে এই অপার্থিব শব্দ, যেন অনেক মানুষ একসাথে কথা বলছে! সাহস করে ফিরে তাকালাম! কই... কেউই তো নেই!
তখনই কীসের সাথে যেন ধাক্কা লাগলো আর সবকিছু অন্ধকার!
জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমাকে এই বদ্ধ ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। শিকল দিয়ে বাঁধা হাত-পা। খাবার দেওয়ার সময় হাত খুলে দেয়, কিন্তু পা খোলে না। ভাগ্যিস হাত খোলে... নইলে এসব লিখতে পারতাম?
এখন ভালোই আছি। ক্লান্ত লাগলে খড়ের বিছানায় ঘুমাই। উদ্ভট স্বপ্নগুলো দেখি না, প্রেতরাও আর আসে না।
পাণ্ডুলিপিটি এখানেই শেষ। নিচের অংশটুকু অন্য কারো লেখা।
[পাগলখানার এক বিষণ্ন রোগীর কাছ থেকে আমরা এই পাণ্ডুলিপিটি পেয়েছি। ভদ্রলোক ছোটবেলা থেকেই অসুস্থ এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তার বাবা ছিলেন খুবই মারকুটে লোক, স্ত্রী আর ছেলেকে প্রায়ই ধরে পেটাতেন তিনি। পাণ্ডুলিপিতে যেমন লেখা আছে ঠিক সেভাবেই গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। এরপর থেকেই পাণ্ডুলিপি লেখকের মস্তিষ্ক বিকৃতির সূচনা, ছোট থেকেই একা একা কথা বলতেন তিনি, মাঝে মাঝেই ভুগতেন প্রচণ্ড জ্বরে। তার পিতামহও পাগল ছিলেন, এই বংশের লোকেদের মধ্যে পাগলামির লক্ষণ বেশ পুরোনো। ভদ্রলোকের স্ত্রীর মৃত্যু এখনো রহস্যময়। শ্যালকের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করে বাড়ির চাকরেরা। তারপর খানিকক্ষণ বাড়ির এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ান তিনি। পাণ্ডুলিপিতে যে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপারের কথা রয়েছে সবকিছুই তার কল্পনা।]
মূল নাম- অ্যা ম্যাডম্যান'স ম্যানুস্ক্রিপ্ট
মূল- চার্লস ডিকেন্স
অনুবাদ- লুৎফুল কায়সার
কেকে/এএম