রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমিকে অপহরণের পর আটকে রেখে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) রাতে নগরীর রাজপাড়া থানার বিলশিমলা এলাকার রায়না কমপ্লেক্স নামের একটি ভবন থেকে অমিকে উদ্ধার করা হয়। একইদিন নগরীর সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের পরিত্যক্ত বাড়িতে এক কলেজ ছাত্রকে আটকে রেখে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে তিন ছাত্র দেড় লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খবর পেয়ে পুলিশ নগরীর উপশহরের পরিত্যক্ত ওই বাড়ি থেকে কলেজ ছাত্রকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমি ও অপহরণকারী দুজনই সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের ঘনিষ্ঠ। জমি ও প্লট বিক্রির টাকার লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধ থেকেই অপহরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ঘটনায় আব্দুর রশিদ (৫০) ও মীম ইসলাম (৩০) নামের দুজনকে আটক করেছে র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। র্যাব-৫ এর ও চন্দ্রিমা থানা পুলিশ এ অভিযান চালায়। আটক মীম হলেন আব্দুর রশিদের গাড়িচালক।
মাদকাসক্তি ও টাকার বিনিময়ে কমিটি দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর জাকির হোসেন অমিকে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার বাড়ি রাজশাহীর জেলার বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জে। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইন্টার্নশিপ করছেন বলে জানিয়েছেন তার বাবা আমির হোসেন।
অমিকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেফতার জমি ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়। গত কয়েক বছর ধরে তিনি সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন এলাকার বিরোধপূর্ণ ও খাসজমি দখল নিয়ে বহুতল ভবন তৈরি করে প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি করে আসছেন তিনি। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাকির হোসেন অমিও রশিদের অংশীদার ছিলেন।
অমির বাবা আমির হোসেন চন্দ্রিমা থানায় দেওয়া অভিযোগে বলেছেন, তার ছেলে পেশায় দন্ত চিকিৎসক। নগরীর ছোটবনগ্রাম ব্যাংক টাউন এলাকায় বসবাস করেন। গত ১৫ জানুয়ারি দিনগত রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে সিএনজি অটোরিকশাযোগে গ্রামের বাড়ি বাগমারা থেকে শহরের ছোট বনগ্রামের বাসায় ফিরছিলেন। বাসায় প্রবেশের সময় ৬ থেকে ৭ জনের একটি সশস্ত্র দল তাকে অপহরণ করে আব্দুর রশিদের বিলশিমলার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায়।
অপহরণকারীরা তার কাছ থেকে ব্যাংকের চেক ও ফাঁকা স্ট্যাম্পে জোর করে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। এরপর তার কাছ থেকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার মুক্তিপণ দাবিতে আটকে রেখে মারধর করা হয়। পরে জানতে পেরে অমির স্ত্রী মিথিলা পারভিন র্যাব-৫ ও চন্দ্রিমা থানায় অভিযোগ করেন। বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে তাকে উদ্ধার করা হয়।
অপহরণের অভিযোগে আটক ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ জানান, জাকির হোসেন অমি একসময় তার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। তারা দুজনই সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিভিন্ন এলাকার বিরোধপূর্ণ ও খাস জমি ক্রয় করে ফ্ল্যাট ও প্লট করে বিক্রি করেন তিনি। গত ৫ আগস্টের আগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অমি এসব কাজে রশিদকে দলীয়ভাবে সহযোগিতা করতেন।
রশিদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, রশিদ ও অমি নগরীর ডাবতলা ও জিন্নানগর এলাকার বিরোধপূর্ণ দুটি জমি সাবেক মেয়রের প্রভাব খাটিয়ে দখলে নেন। এই জমি দখল বাবদ সাবেক মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিলরসহ কয়েকজনকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। এই টাকাটা প্লট ক্রেতাদের কাছ থেকে তুলে নেন অমি।
তবে গত ৫ আগস্ট সাবেক মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আত্মগোপন করায় এই টাকা অমি আর কাউকে দেননি। রশিদ বিষয়টি সম্প্রতি জানতে পেরে টাকা উদ্ধারের জন্য অমির ওপর চাপ দেন। কিন্তু অমি টাকা না দিয়ে তালবাহানা করতে থাকেন। অবশেষে বৃহস্পতিবার রাতে রশিদের লোকজন অমিকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখেন।
গোদাগাড়ীর বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আব্দুর রশিদ একসময় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দেন কাতারে। কয়েক বছর কাতারে থেকে সেখানকার একজন ব্যবসায়ীর বিপুল টাকা মেরে দিয়ে দেশে চলে আসেন। এসে নগরীর উপশহর এলাকায় বসবাস শুরু করেন এবং জমির ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বর্তমানে ডাবতলা এলাকায় রশিদের তিনটি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। আব্দুর রশিদ হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলেও এলাকার লোকজন জানিয়েছেন।
চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিয়ার রহমান জানান, অপহৃত জাকির হোসেন অমির বাবা আমির হোসেন বাদী হয়ে ৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। অপহরণ চক্রের মূলহাতা আব্দুর রশিদ ও তার গাড়ি চালক মীম ইসলামকে আদালতে চালান করা হয়েছে। অপহরণের সঙ্গে জড়িত বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের উপশহর এলাকার পরিত্যক্ত বাড়িতে এক কলেজছাত্রকে আটকে রেখে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে তিন ছাত্র দেড় লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফাহিম হোসেন জীম রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
ফাহিম হোসেন জীম জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগে তাকে নগর ভবনের সামনে থেকে অপহরণ করে উপশহরে সাবেক মেয়রের পরিত্যক্ত বাড়িতে আটকে রেখে ছাত্রসমন্বয়ক পরিচয়ে দেড় লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। থবর পেয়ে মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান কাফির নেতৃত্বে এলাকাবাসি তাকে উদ্ধার করে।
নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী মাসুদ বলেন, সমন্বয়ক পরিচয়ে এক কলেজছাত্রকে সাবেক মেয়রের পরিত্যক্ত বাসায় আটকে রাখা হয়েছিল। পুলিশ গিয়ে ছেলেটিকে উদ্ধার করেছে।
কেকে/এএম