আমরা জানি, যা একাধিক দেশ বা মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং যেখানে সাধারণত বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশগুলো জড়িত থাকে বিশ্বযুদ্ধ বলতে এমন এক ধরনের ভয়ানক যুদ্ধকে বোঝানো হয়। এই যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব খুবই বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বযুদ্ধ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি সমাজ, অর্থনীতি, এবং সংস্কৃতিতে বিপ্লব সৃষ্টি করে। আর বিপ্লবে ইতিবাচক সম্ভাবনা চেয়ে নেতিবাচক সম্ভাবনা বেশি প্রকাশিত হয়। ইতিহাসের পাতা খুললেই আমরা দুইটা প্রধান ও ভয়ংকর বিশ্বযুদ্ধ দেখতে পাই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপ থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সামরিক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয়কেই দায়ী করতে পারি। এ যুদ্ধে প্রধানত দুটি গোষ্ঠী অর্থাৎ মিত্রশক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া) এবং মধ্যশক্তি (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য) যদি সামরিক প্রতিযোগিতা, জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি না করত তাহলে ভয়ানক যুদ্ধটাই হতো না এবং বিশ্ববাসী বহু জীবন ও জানমালের ক্ষতির পরিস্থিতি স্বীকারও হতো না।
অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯-১৯৪৫ সালে সম্পন্ন হয়। বলা হয়ে থাকে এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ, যা ইউরোপ থেকে এশিয়া, আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যারা দেখেছে বা বিশ্বযুদ্ধের নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন তারা জীবনে কখনো যুদ্ধের আশা করতেই পারে না। যুদ্ধের শেষের দিকে ও যুদ্ধের পর তাদের স্লোগান হয়েছিল, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না আমরা শান্তি চাই’। আর এমন হবেই না কেন? এত এত প্রাণ গেল, কত কত নারী বিধবা হলো, কত কত সন্তান এতিম হলো, কত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বেই তাদের বাবাকে হারাল তার সঠিক সংখ্যা গণনার বাহিরে।
আমি, আপনি ও আমরা সবাই হয়তো এমন দৃশ্য মোকাবিলা করে একই স্লোগান জপ করতাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলেও প্রধান কারণ হিসেবে বলতে পারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অসমাপ্ত ইস্যু, ফ্যাসিবাদী নীতির উত্থান এবং জার্মানির নেতৃত্বে আক্রমণাত্মক সামরিক নীতি এবং এতেও দুই পক্ষ ছিল : মিত্রশক্তি (যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন) এবং অক্ষশক্তি (জার্মানি, ইতালি, জাপান)।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলতে হয় প্রত্যক্ষভাবে দুইটা মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও পরোক্ষভাবে তার নিস্তেজ ঘটে নাই। বরং যেদিন থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল সেদিন থেকেই পৃথিবীতে আরেকটা যুদ্ধের যাত্রা হয়। আর এ যুদ্ধের যাত্রার কারণ সমাজতন্ত্র বলয় ও পুঁজিতন্ত্র বলয়। এ যুদ্ধ যতটা না দৃশ্যমান তার চেয়ে হাজার গুণ অদৃশ্যমান। এজন্যই এ যুদ্ধকে স্নায়ুযুদ্ধ বলা হয়। এখানেই শেষ না, কেন শেষ না? কারণ ওই স্নায়ুযুদ্ধই দিনদিন আরেকটা মহাযুদ্ধের দিকে পৃথিবীকে নিয়ে যাওয়ার দিকে এগিয়ে। সৃষ্টিকর্তা না করুক— আরেকটা মহাযুদ্ধ মানে তৃতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত যদি হয় তাহলে তার প্রধান কারণ হবে পৃথিবীর পরা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দিনের পর দিন স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
কেউ কেউ যুদ্ধ চায়, সবাই নয়, আবার অনেকেই যুদ্ধ চায়, কেউ কেউ নয়। যে বা যিনি যুদ্ধ চায় না তার কাছে আমার কোনো প্রশ্ন বা অভিযোগ নেই। কারণ তিনি বা আমি দুজনেরই মতামত অভিন্ন। কিন্তু যিনি বা যারা যুদ্ধ চান তিনি বা তার নিকট প্রচুর রাগ নিয়ে বিনীতভাবে প্রশ্ন রইল, কেন যুদ্ধ চান? যুদ্ধ কী কখনো শান্তি আনতে পারছে অথবা শান্তি আনবে কখনো? খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি ওই প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর হবে যুদ্ধ কখনো শান্তি ডেকে আনে না, যুদ্ধ শুধু ধ্বংসই আনতে পারে।
খুবই দুঃখের বিষয় হচ্ছে— যুদ্ধ যে শান্তি ডেকে আনে না তা আমরা জানি, বুঝি ও মানি কিন্তু তারপরও যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাই। আমরা চিন্তা করি আমরা বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জয়ী হবো। চিন্তা করি না একটা যুদ্ধে দুইটা পক্ষ থাকে এবং দুই পক্ষকেই কমবেশি যুদ্ধের ফলাফল মানে ধ্বংসাত্মক অবস্থা ভোগ করতে হয়। ‘ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’ নামক প্রবাদটি অন্য সবকিছুর সঙ্গে যতটা না সম্পর্কযুক্ত যুদ্ধের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সম্পর্কযুক্ত। কারণ যুদ্ধের ভেতরের অবস্থাই ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার প্রবাদের মতো।
আজকের আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে— পৃথিবীতে এত এত মানবাধিকার সংগঠন, উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১৯৪৫ সালে সৃষ্টি জাতিসংঘকেই প্রধান সংঘ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হলো : মানবাধিকার রক্ষা এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ, আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা, জাতির মধ্যে সৌহার্দ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু বাস্তবতায় কতটুকু সক্ষম হয়েছে তা বর্তমান পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝা যায়। হ্যাঁ, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বৈশ্বিক উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু শান্তি হয়নি। শান্তি নামক উন্নয়নে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগঠনটি এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফল তা বলতে পারি না। কীভাবে সফল হবেই যদি একটা আন্তর্জাতিক সংগঠনের মূল দেশগুলোই সব সময় (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িত থাকে?
দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ হচ্ছে। পূর্বেই বলেছি যুদ্ধ কখনো শান্তি ডেকে আনে না। যুদ্ধ যদি কিছু আনে সেটা ধ্বংস আর ধ্বংস। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও রাশিয়া-ইউক্রেন ভয়ানক কান্ডে দিনের পর দিন হত্যাযজ্ঞ হয়েই যাচ্ছে। এছাড়া বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এগুলো কি ‘জাতিসংঘ’ দেখে না? এগুলো কী জাতিসংঘ সমাধান করতে পারে না?
বিশ্বের পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো কী এগুলোর সমাধান করতে পারে না? লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে, হাজার হাজার নারী বিধবা হচ্ছে, শত শত শিশু এতিম হচ্ছে আর সম্পদের ক্ষতি তো আছেই। এক দেশ অন্য দেশের সঙ্গে, এক জাতি অন্য জাতির সঙ্গে, এক ধর্ম অন্য ধর্মের সঙ্গে, এক ভাষাভাষী অন্য ভাষাভাষীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। ফলাফল শুধু রক্ত আর রক্ত দেখতে পাই। আগেই বলেছি ভুল করেও যুদ্ধ শান্তি ডেকে আনে না। যুদ্ধ আনতে পারে সীমাহীন ধ্বংস। পৃথিবীর এ নেতিবাচক পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের ভাতে মরার আগে একে-অপরের হাতে আগে মরতে হবে। পৃথিবীতে তৃতীয় মহাযুদ্ধের শুরু হবে। আবার বিশাল জীবন ও জানমালের বলি হবে। হয়তো আমরা সবাই বেঁচে থাকব না, হয়তো কেউ কেউ বেঁচে থাকব কিন্তু বিশ্ব পরিণত হবে একটা ধ্বংসস্তূপে।
প্রতিযোগিতা প্রয়োজন কিন্তু শারীরিক ও মানসিক ধ্বংসের প্রতিযোগিতা নয়, কার থেকে কারা সৃজনশীল, কার থেকে কারা নান্দনিক, কার থেকে কারা কল্যাণকারী এরূপ প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত। মানুষ মানুষে ভেদাভেদ নয় বরং সাম্য থাকা উচিত। জাতিতে জাতিতে হিংসা, ধর্মে ধর্মে বিভেদ, বর্ণে বর্ণে ঝগড়া পরিহার করে একে অন্যের সুহৃদ হওয়া উচিত। তাহলেই সৃষ্টিকর্তা খুশি হবে ও শান্তি আসবে।
সবশেষে বলব, যুদ্ধ পৃথিবীর বুকে বয়ে আনে ধ্বংসের তাণ্ডব। এটি শুধু মানুষের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করে না, বরং মানবতার মূলে আঘাত হানে। ইতিহাস সাক্ষী, যুদ্ধ কখনোই কোনো স্থায়ী সমাধান বা প্রকৃত উন্নতি আনতে সক্ষম হয়নি। যুদ্ধের ক্ষত বহন করে সমাজের প্রতিটি স্তর— শিশু, নারী, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে প্রকৃতি পর্যন্ত। যুদ্ধের প্রতিদানে আমরা পাই ঘরহীন মানুষ, শূন্য দৃষ্টি আর ভাঙা স্বপ্ন।
অপরদিকে, শান্তি এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে ভালোবাসা, সৌহার্দ, এবং মানবিকতা বিকশিত হয়। শান্তি শুধু অস্ত্রবিরতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে জাতি-জাতি, ব্যক্তি-ব্যক্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে একসঙ্গে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। শান্তির মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। এটি পৃথিবীর প্রতিটি কোণকে আলোকিত করে তোলে। আজকের এ পৃথিবীতে যুদ্ধের শিকল থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। সংঘাতের পরিবর্তে সংলাপ এবং বিবাদে সমাধানের পরিবর্তে সহযোগিতার পথই আমাদের নিতে হবে।
যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়; বরং এটি আরো জটিলতা সৃষ্টি করে। শান্তি আমাদের জীবনের সঠিক দিশা এবং টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি। সুতরাং, আমাদের সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি পৃথিবী গড়া যেখানে যুদ্ধের শব্দ নয়, বরং শান্তির সুর বাজবে। বিশ্বের সব মানুষের কাছে অনুরোধ বিশেষ করে পরাশক্তি দেশ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে যুদ্ধের খেলা বন্ধ করে শান্তির খেলা শুরু করুন। আসুন, আমরা যুদ্ধের হাত থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির পতাকা তুলে ধরি এবং পৃথিবীকে একটি সুন্দর, বাসযোগ্য স্থান হিসেবে গড়ে তুলি।
কারণ যুদ্ধ নয়, শান্তিই আমাদের প্রকৃত প্রয়োজন। আর শান্তি অর্জনে সফল হলেই সর্বশক্তিমান খুশি হবেন। আজকের চূড়ান্ত বাক্যে আবারও শুনিয়ে যেতে চাই— যুদ্ধ দিয়ে শান্তি নয়, শান্তি দিয়ে যুদ্ধের অস্তিত্ব বিলীন করতে চাই।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
কেকে/এএম