গ্রামের ছোট্ট একটা পুকুরের ধারে এক সময় ছিল এক মাটির ঘর, যেখানে সারা দিন গাছের ছায়ায় বসে থাকত ছোট্ট মেয়ে পূর্ণিমা। তার স্নিগ্ধ হাসি, রোদেলা মুখ আর বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ, সবাইকে আকর্ষণ করত। কিন্তু পূর্ণিমা জানত না, তার এই সরলতা ও নির্ভীকতা একদিন তাকে ঠেলে দেবে এক গভীর রহস্যের দিকে।
গ্রামের ছেলেরা যখন মাঠে ক্রিকেট খেলত বা বাঁশের খেলা খেলত, পূর্ণিমা তখন হাঁস-মুরগির যত্ন নিত, আর মাঝে মাঝে নদীর ধারে চুপচাপ বসে থাকত। সেখানে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল অয়ন। অয়ন ছিল গ্রামের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলে। তার চোখে কিছু একটা ছিল, যেন সে সব কিছু জানে, সব কিছু বুঝে। কিন্তু তার মধ্যে একটা অদ্ভুত রহস্য ছিল, যা গ্রামের সবাই বুঝতে পারত না।
একদিন, পূর্ণিমা যখন নদীর ধারে বসে ছিল, অয়ন এসে তার পাশেই বসে পড়ল। তার মুখে কোনও হাসি ছিল না, বরং একটু গম্ভীর মনে হচ্ছিল।
‘কী হলো, অয়ন? আজ তোর মুখের হাসি নেই কেন?’ পূর্ণিমা প্রশ্ন করল।
অয়ন একটু চুপ থেকে বলল, ‘পূর্ণিমা, জানিস তো আমাদের গ্রামে যে পুরোনো মন্দিরটা আছে, সেখানে একটা অদ্ভুত ঘটনার কথা সবাই বলে। কেউ শুনে না, কিন্তু আমি জানি...’
পূর্ণিমা অবাক হয়ে তাকাল। ‘কী ঘটনার কথা বলছিস?’
অয়ন সোজা চোখে পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলতে পারব না, কিন্তু... মন্দিরের এক কোণে একটা রহস্য আছে, যা আমাদের ভালবাসা কিংবা আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যদি আমরা সেটা খুঁজে না বের করি, তবে হয়তো আমাদের জীবনে একদিন কোনো না কোনো অশুভ কিছু ঘটবে।’
পূর্ণিমা কিছু বুঝতে পারছিল না। ‘তুমি কী বলছ, অয়ন? তুমি কি ভয়ে আছো?’
অয়ন হেসে বলল, ‘না, ভয়ের কিছু নেই। আমি শুধু জানি, আমাদের ভালোবাসার গোলকধাঁধায় আমরা হারিয়ে যেতে পারি যদি আমাদের এই রহস্যের সন্ধান না পাই।’
এবার পূর্ণিমা তার কথাগুলো গুরুত্ব সহকারে শুনতে লাগল। গ্রামে অনেক বছর আগের অদ্ভুত কিছু ঘটনা ছিল, তবে সেটা কেউ আর সঠিকভাবে জানত না। পুরোনো মন্দিরের আশেপাশে এমন কিছু মিথ ছিল, যা মানুষের মনকে চঞ্চল করে দিত।
একদিন, পূর্ণিমা আর অয়ন ঠিক করল, তারা মন্দিরে গিয়ে সেই রহস্য খুঁজে বের করবে। রাতে তারা লুকিয়ে মন্দিরে চলে গেল। মন্দিরটি ছিল ভয়ানক নির্জন, পুরো জায়গাটি একেবারে নিস্তব্ধ। পুরোনো কাঠের দরজা, ভাঙাচুরা মূর্তি, আর এক অদ্ভুত আবহ, যেন কিছু একটা তাদের দিকে টানছিল।
অয়ন পূর্ণিমার হাত ধরে বলে, ‘এটা আমাদের জন্য। আমরা যদি সফল হই, তবে এই ভালোবাসার গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পাবো। তবে সাবধানে থেকো।’
মন্দিরের এক কোণায় গিয়ে তারা একটি পুরোনো পাথরের টুকরো দেখতে পেল। সেখানে এক রহস্যময় লেখা ছিল, যা পূর্ণিমা পুরোপুরি বুঝতে পারছিল না।
‘এটা কী বলছে, অয়ন?’ পূর্ণিমা প্রশ্ন করল।
অয়ন পাথরটির দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে বলল, ‘এটা একটি সংকেত। যদি আমরা এই সংকেত অনুসরণ করি, তবে আমরা আমাদের জীবন থেকে সমস্ত বিভ্রান্তি দূর করতে পারব।’
তাদের অনুসরণ করার পথে নানা বাঁধা আসতে লাগল। তবে শেষ পর্যন্ত তারা পৌঁছে গেল এক গুহায়, যেখানে ছিল এক পুরোনো বই। বইটি খুলে, অয়ন আর পূর্ণিমা একটি অদ্ভুত সত্য জানতে পারে—
‘এই ভালোবাসা সঠিক পথে চললে এক অমর শক্তি হয়ে ওঠে। কিন্তু গোলকধাঁধার মধ্যে হারিয়ে গেলে, এটি জীবনের সব কিছু মিথ্যে করে দিতে পারে।’
পূর্ণিমা বুঝতে পারল, তাদের সম্পর্কের মধ্যে যদি কোনো এক অজানা বিভ্রান্তি বা ভুল ঢুকে যায়, তাহলে তারা নিজেদের হারিয়ে ফেলবে। তাদের ভালোবাসা এক সত্যি প্রেমের পথে থাকতে হবে, যাতে তারা এই গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পায়।
অয়ন ও পূর্ণিমা একে অপরকে শক্ত করে ধরল, এবং তাদের জীবনের সঠিক পথে চলতে থাকল। তারা জানত, এই ভালোবাসার রহস্য যে হারাবে, সে একদিন নিজের পথ খুঁজে পাবে।
গল্পটি শেষ হলেও, তাদের হৃদয়ে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করেছিল। গোলকধাঁধার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার ভয় এখন আর তাদের কাছে ছিল না। তারা জানত, তাদের ভালোবাসা এখন আরও গভীর এবং সত্যি, এবং তারা কখনোই একে অপরকে ছাড়বে না।
এই হলো ভালোবাসার গোলকধাঁধার রহস্য, যা দুই হৃদয়কে একসূত্রে বাঁধতে শিখিয়েছিল।
কেকে/এএম