আওয়ামী আমলে বাংলাদেশের ওপর প্রবল কর্তৃত্ব ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতের। করিডোড়-ট্রানজিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছে তারা বাংলাদেশ থেকে। বিষয়টা এমন ছিল, এটা যেন তাদেরই একটা অঙ্গরাজ্য! তবে জুলাই বিপ্লবে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে সেই আধিপত্য খর্ব হয় তাদের। হাসিনার নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে নিজেদের অনুগত রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিবেশীরা।
সংখ্যালঘু ইস্যু থেকে শুরু করে তাদের অনুগত কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশ বিষয়ে নানা অপপ্রচার করে অস্থিরতা তৈরি করে চলছে তারা। ভারতীয়দের সবশেষ পরিকল্পনায় সংযোজিত হয়েছে সীমান্ত উত্তেজনা। দেশের একাধিক সীমান্তের শূন্যরেখায় আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে এ উত্তেজনার সৃষ্টি করে তারা। তবে বিজিবি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। তখন পিছু হটলেও দমে যায়নি ষড়যন্ত্রকারীরা।
গতকাল দেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কিরণগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় অতর্কিত অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশিদের আমগাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে বিএসএফ এবং ভারতীয় বাসিন্দারা। এ সময় মাইকিং করে স্থানীয়দের সহযোহিতার আহ্বান জানায় বিজিবি। পরে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে ভারতীয়দের এ কার্যক্রমকে রুখে দেওয়া হয়। তখন দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশি বাসিন্দাদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড এবং টিয়ারশেলের বিস্ফোরণও ঘটায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তবে ছয়জনের নাম নিশ্চিত করেছে এলাকাবাসী। তারা হলেন শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের ঝাইটন আলীর ছেলে আসমাউল (১৮), বিশ্বনাথপুর গ্রামের এলাকার বাবু (২৬), বিশ্বনাথপুর গ্রামের মো. রনি, কালীগঞ্জ নামোটোলা এলাকার যুবক মেসবাহুল হক, কালিগঞ্জ মালোপাড়ার গ্রামের ফারুক (৩৫) এবং কালিগঞ্জ গ্রামের জিন্নুরের ছেলে তরিকুল (৫৫)।
গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের কিরণগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ করে বিএসএফ ও শতাধিক ভারতীয় মিলে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং বাংলাদেশ প্রান্তের ১২ থেকে ১৫টি আম গাছ কেটে ফেলে। পরে বিজিবির টহল দল মাইকিং করে স্থানীয়দের সহযোগিতার আহ্বান জানান। এ সময় স্থানীয়রা বিজিবিকে সহযোগিতা করতে সীমান্ত এলাকায় ছুটে আসেন। দুই পাশে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিএসএফ সদস্যরা ৪টি সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। স্থানীয় ভারতীয়রা পাথর ছুড়ে মারে। এতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। পরে ভারতীয়রা কাটা গাছ ও ডালপালা ফেলে পালিয়ে যায়।
বিনোদপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিজিবির সহযোগিতার মাইকিং শুনে বিজিবিকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসি। এ সময় বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকরা সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, ককটেল ও পাথর নিক্ষেপ করে। এ ছাড়া ভারতীয়রা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেয় এবং বাংলাদেশের নাগরিকরা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেয়। পরে আমাদের পাল্টা ধাওয়ায় তারা কাটা গাছ ফেলে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. বাদশা বলেন, শনিবার দুপুরে সীমান্তে শূন্যরেখার পাশে বাংলাদেশের ভেতরের জমিতে গম কাটতে গিয়েছিলেন তারা। তখন ভারতীয় নাগরিকরা এসে বাংলাদেশের ভেতরের কয়েকটি আমগাছ কেটে দেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় ভারতীয় নাগরিকদের হাঁসুয়ার আঘাতে ও তাদের ছোড়া পাথরে কয়েকজন বাংলাদেশি আহত হন।
ভারতীয়দের হাঁসুয়ার আঘাতে আহত হয়েছেন বিনোদপুর ইউনিয়নের কালীগঞ্জ নামোটোলা এলাকার যুবক মেসবাহুল হক। তিনি জানান, তিনিসহ মোট তিনজন আহত হয়েছেন। অন্য দুজনের মধ্যে বিশ্বনাথপুর গ্রামের মো. রনি ভারতীয়দের ছোড়া পাথরের আঘাতে ও মো. ফারুক হাঁসুয়ার আঘাতে আহত হয়েছেন। বিজিবি জানিয়েছে, পরে শনিবার বিকাল ৪টার দিকে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পতাকা বৈঠকে গাছ কাটার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ঘটা ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানিয়েছে বিএসএফ।
বিজিবির ৫৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া সীমান্তে অবস্থান করছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে তার মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। পরে বিকেলে এক ব্রিফিংয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘চৌকা ও কিরণগঞ্জ ক্যাম্পের মাঝামাঝি সীমান্ত পিলার ১৭৭ বরাবর বাংলাদেশের ভেতরে কিছু আমগাছ ছিল। ওই আমগাছ কাটা নিয়ে ভারতীয় নাগরিক ও বাংলাদেশি নাগরিকের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন শূন্যরেখা বরাবর দুই দেশের নাগরিকেরা দাঁড়িয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বিজিবির জনবল বাড়ানো হয় এবং তারা ঘটনাস্থলে চলে আসেন। পরে বিকাল চারটা ১০ মিনিটে বিজিবি ও বিএসএফের কমান্ডার পর্যায়ে একটি পতাকা বৈঠক হয়। যেখানে এ ঘটনার জন্য বিএসএফের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি গাছ কাটার বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।’
বিজিবি কমান্ডার বলেন, ‘এ ঘটনার সম্পূর্ণ বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা মাঠে আছি। কেউ যাতে শূন্য রেখা অতিক্রম না করে এবং উত্তেজনা প্রশমিত করতে বিজিবি প্রস্তুত আছে। বিজিবির পাশে দেশপ্রেমিক জনগণও আছেন।’
আহতের ব্যাপারে জানতে চাইলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া জানান, তাদের কাছে আহতের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিএসএফের পক্ষ থেকে হতাহতের বিষয়েও কিছু জানানো হয়নি। তারা (বিএসএফ) উচ্ছৃঙ্খল লোকজন (মব) নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে, যেটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে বিজিবি মহাপরিচালককে তারা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। আশা করছেন, বিজিবি ও বিএসএফ সদর দফতরের উচ্চপর্যায়ে এ ব্যাপারে কথা হবে।
কেকে/এআর