আগে প্রাকৃতিকভাবে বনে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের ভরপুর থাকলেও এখন আর সে দৃশ্য নেই । বেশ কয়েক যুগ থেকে ন্যাড়া পাহাড় হিসেবে ছিল জোয়ারিয়ানালার অধিকাংশ বনের জায়গা। কক্সবাজারে বনের গাছ কাটতে গিয়ে গোলাগুলিতে বনখেকো নিহত হওয়ার নজিরও আছে। তারপরও বনখেকোরা থেমে থাকেনি বন নিধনে। বন উজাড় করে ন্যাড়া করে ফেলেছিল বনখেকোরা।
কক্সবাজারের সেই ন্যাড়া ও অনাবাদী পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির চারা গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে বনবিভাগ। রামু উপজেলার জোয়রিয়ানারা রেঞ্জের উখিয়ারঘোনা, দোয়ালের ঝিড়ি ব্যাংডেপা বিটের টিটিলাঘাট এলাকায় সর্বমোট ৫১২ হেক্টর অনাবাদী বনভূমিতে প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে গত বছরের বর্ষা মৌসমে। আগামী ২-৩ বছরে রোপণ করা এসব চারাগাছ বড় হলে সবুজ সমারোহে বদলে যাবে এই অঞ্চলের পরিবেশ। এছাড়াও জীবিকায় বন নির্ভর জনগোষ্ঠীর বনের উপর চাপ কমে আসবে। ইতিমধ্যে এই বনায়নকে কেন্দ্র করে এলাকার প্রায় কয়েক হাজারের অধিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নতুনভাবে বনায়ন সৃজিত পাহাড়গুলো দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন সবুজ অট্টালিকা। অথচ এই পাহাড়গুলো এক সময় অযত্ন, অবহেলা ও পতিত ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। অতিরিক্ত মাত্রায় গাছ কাটা ও বন উজাড়ের কারণে বিগত ৩০ বছর ধরে অনাবাদী ছিল এই বনভূমি। অনাবাদী এসব বনভূমিতে পর্যায়ক্রমে নতুনভাবে বনায়ন সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ।
বন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যপ্রাণীর বাসস্থান নষ্ট, জৈব বিন্যাসের ক্ষতি ও অনুর্বরতা রোধে অনাবাদী সব বনভূমিকে পর্যায়ক্রমে সবুজায়নের পাশাপাশি বননির্ভর জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের আওতাধীন রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছ-পালা কেটে বন উজাড় করেন বনদস্যূরা। এতে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট, জৈব বিন্যাসের ক্ষতি ও অনুর্বরতা সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাগুলোর খুব বেশি ভূমি ক্ষয় ও অনাবাদী জমিতে পরিণত হয়। এভাবে প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে যায়। তিনদশক পর এসব অনাবাদী বনভূমিতে নতুন করে বন সৃজনের উদ্যোগ নিয়েছে বনবিভাগ।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারের টেকসই বন ও জীবিকা(সুফল) প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে গত ২০২৩-২৪ আর্থিক সনে জোয়ারিয়ানালা বিটের উখিয়ারঘোনা এলাকায় ২১২হেক্টর, দোয়ালের ঝিড়ি এরাকায় ১৫০হেক্টর এবং ব্যাংডেপা বিটের টিটিলাঘাট এলাকায় ১৫০হেক্টরসহ সর্বমোট ৫১২হেক্টর দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়ন করা হয়। এতে সরকারের প্রায় এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানা যায়। রোপণ করা হয়েছে ১২ লাখ ৮০হাজার চারার মধ্যে রয়েছে চিকরাশি,শিমুল তুলা,কদম,আমলকি,অর্জুন,কাঞ্জলভাদি বকাইন,দাদমর্দন,ওলটকম্বল, কৃষ্ণচুড়া, গামার, কাঠবাদামসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, রোপণকৃত চারা অত্যন্ত সতেজ ও সবুজ হয়ে বেড়ে উঠছে এমনটা নজরে এসছে। অন্যদিকে স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তাদের এলাকায় বাগান সৃজন করায় অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে প্রতিদিন কাজের জন্য অন্য কোথাও যেতে হচ্ছে না। নার্সারী ও বাগান সৃজন কাজে নিয়োজিত মাঝি নজির হোসেন, আবু তাহের ও ফরিদ মিয়া জানান, তারাসহ অন্যরা নিজ এলাকায় নার্সারী ও বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পাচ্ছে।
জোয়ারিয়ানালা বিটের হেডম্যান বশির আহমদ জানান, সুফল প্রকল্পের নার্সারী ও বনায়ন কাজ চলমান থাকায় স্থানীয় পুরুষ ও মহিলা দিনমজুরা ব্যপকভাবে উপকৃত হচ্ছে। রোপিত চারার নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষণ করায় দ্রুত বেড়ে উঠছে।
এবিষয়ে জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা জনাব কে এম কবির উদ্দিন জানান, জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। জিপিএস ম্যাপের সাহায্যে বাগানের সীমানা নির্ধারন করা হয়েছে। যা বিভাগীয়ভাবে একাধিকবার পরিমাপ করে বাগানের পরিমান নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, ভবিষ্যতে সৃজিত বাগানের চারা গাছগুলি সফল বনে পরিনত হবে এবং এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও জানান যে সুফল প্রকল্পের আওতায় এপর্যন্ত ২১০ জন সুফলভোগীকে তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা ঋন প্রদান করা হয়েছে। যা দ্বারা তারা হাস মুরগী পালন, গাভী ক্রয়, সবজী চাষসহ বিবিধভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
এছাড়া কমিউনিটি ডেভলেপমেন্ট ফান্ডের আওতায় এলাকায় রাস্তা নির্মাণ ও সড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সোলার লাইট স্তাপন করা হয়েছে। সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে বন বিভাগের এ ধরনের কার্যক্রম এলাকায় ব্যাপক প্রশংশিত হয়েছে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, গত আর্থিক সনে জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে সুফল প্রকল্পের ৭২ জন সুবিধাভোগীকে হাস মুরগী পালন, সবজী চাষ, গবাদি পশু মোটাতাজা করন সহ ৬টি ট্রেডে প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে জোয়ারিয়ানারা এলাকায় গেলে জানা যায়, গত ১৯ডিসেম্বর জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে ৫টি অবৈধ করাতকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে রেঞ্জ কর্মকর্তা কে এম কবির উদ্দিন উচ্ছেদ করেন। ফলে জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ এলাকায় বর্তমানে করাতকল শুন্য রয়েছে। যা অবৈধ কাঠ পাচারকারীদের কাঠ পাচার রোধে এক কঠোর পদক্ষেপ বলে এলাকায় ব্যপক প্রশংশিত হয়েছে। বনবিভাগের কঠোর অবস্থানের কারণে জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জের বন হতে কোন কাঠ চোরাকারবারীরা পাচার করে ইট ভাটাসহ কোথাও সরবরাহ করতে পারছে না।
এছাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তার কারণে এলাকায় বালি পাচারসহ পাহাড় কাটা এখন প্রায় শুন্যের কোটায় রয়েছে, যার কারণে স্থানীয় কাঠ, বালি পাচারকারীসহ পাহাড়খেকোদের রোষানলে পড়েছেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি কিছু বনখেকোরা রেঞ্জ কর্মকর্তর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মারুফ হোসেন জানান, বনসংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে বননির্ভর জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকার সংস্থানের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ফলে বনের উপর মানুষের চাপ কমে আসবে। প্রতিটি রেঞ্জের ন্যায় জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে বেশ ভালভাবে সুফলে চারা রোপণ হয়েছে। আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই পাহাড়ি এলাকা সবুজে ভরে উঠবে। প্রকৃতি ফিরে পাবে তার নিজস্ব স্বত্তা। আবার মেয়াদ শেষ হলে এই বনায়ন থেকে সুফল ভোগ করবে স্থানীয় জনগোষ্টি। তাই সকলের উচিৎ এই বনায়ন রক্ষা করা এবং সরকারের সুফল বনায়নের সুফল ভোগ করা।
কেকে/এজে