সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫,
৭ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: ৬ সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বাড়লো       ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা      ফ্যাসিবাদের কালো ছায়া এখনো রয়ে গেছে: জামায়াত আমির      গণমাধ্যমকে অবশ্যই পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে: জুনায়েদ সাকী      কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে টিস্যু পেপারে চিঠি লিখলেন দীপু মনি      মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৯৩ জনের ফল স্থগিত      বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ নবায়ন উদ্বোধন করলেন তারেক রহমান      
মুক্তমত
বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ কি আদৌ হয়েছে
মিল্লাত হোসেন
প্রকাশ: সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫, ৮:৩২ পিএম  (ভিজিটর : ৯৫)

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণসংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায় ঘোষণার ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ। অন্যদিকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর রায় বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলো সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করা হয়। সে হিসেবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের যে সাংবিধানিক নির্দেশনা আমাদের ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানে রাখা হয়েছিল তার বাস্তবায়নের পথের প্রথম পদক্ষেপের ১৭ বছর পূর্তি হলো।

কিন্তু, এ রায়ের নানা অপব্যাখ্যা করে অনেক ভুল তথ্য ও অপ তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে রায়ের মর্মবস্তুকে জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা রকমের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—১ নভেম্বর ২০০৭ বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেছে; মাসদার হোসেন মামলা বিচারের এখতিয়ারই ছিল না আদালতের; একতরফা বিচার হয়; রায়ের সিদ্ধান্তগুলো ঘোষণামূলক তাই বাস্তবায়িত করা বাধ্যতামূলক ছিল না; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এখতিয়ার ছিল না রায় বাস্তবায়ন করার; পৃথকীকরণের পর মামলা বেড়েছে; এতে বিচারকদেরই বেতন-ভাতা-সুবিধা বেড়েছে; জনগণের কোনো লাভ হয়নি; রায়ে ম্যাজিস্ট্রেসি পৃথক করার কোনো প্রার্থনাই ছিল না; ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি ইত্যাদি। এসব মিস ইনফরমেশন ও ডিস ইনফরমেশনের ফ্যাক্ট চেকিং করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা তাই একান্তই আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০০৭ সালের ১ নভেম্বর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি পৃথক করার পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে জেনে বা না জেনেই একটি দাবি করা হয় যে— সেদিন থেকেই বিচার বিভাগ পৃথক হয়ে গেছে বা বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, এ দাবি একটি গুরুতর ভুল। বিচার বিভাগ পৃথক বা স্বাধীন কিছুই হয়নি।

পৃথকীকরণ বলতে বোঝায় প্রধানত— সরকার আর ক্ষেত্রবিশেষে আইনসভা থেকে। কিন্তু, বাস্তবে যেটা হয়েছে তা হলো— আগে ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, যাদের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারের জনপ্রশাসন (পূর্বতন সংস্থাপন) মন্ত্রণালয়ে। আর ১ নভেম্বরের পর বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতা লাভ করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ মূলত নির্বাহী বিভাগের হাতে থেকে যায় আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। অর্থাৎ ক্ষমতা এক ধরনের ব্যক্তিদের হাত থেকে অন্য ধরনের ব্যক্তিদের হাতে হস্তান্তরিত হলেও নাটাই সরকারের হাতেই রয়ে যায়।

তবে হ্যাঁ, রায়ের আলোকে একটা অর্জন কাগজে-কলমে হয়েছিল। এটা হলো বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা এবং তা নির্বাহী বিভাগের ওপর প্রাধান্য লাভ করা। কিন্তু, বাস্তবে এটার প্রয়োগ ছিল সীমিত ও প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ। আর সরকারও বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ছিল যুদ্ধংদেহী। এর তীব্রতা কতটা ছিল, সেটা একজন প্রধান বিচারপতি বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করার উদ্যোগ নিলে তাকে পদছাড়া তো বটেই, চরম লাঞ্চনার ভেতর দিয়ে দেশছাড়া করা থেকেই দেখেছিল দেশবাসী। আরেক ঘটনায় দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা বরগুনায় একজন সরকারি দলের নেতা ও সাবেক এমপিকে দুর্নীতি দমনের মামলায় জামিন না দেওয়ার কারণে একজন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজকে সেদিনই দেশের এক সর্ব উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে বদলি করে তৎক্ষণাৎ দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়। এতেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, সেদিনই একজন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজকে জেলা ও দায়রা জজের ভার অর্পণ করে তাকে দিয়েই সে ব্যক্তির জামিন মঞ্জুরের মতো চরম বিচারিক নৈরাজ্যকর ঘটনার অবতারণার কথাও মনে রাখা যেতে পারে। অথচ যে কোনো ধরনের বিচারিক ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখা এবং এর দায়টি বিচার বিভাগের ওপর চাপিয়ে দিতেই এ সত্য কথাটি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয় প্রধানত রাজনৈতিক নির্বাহী ও তাদের অধস্তন বিভিন্ন সহায়ক অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে, যাদের বিচারিক ক্ষমতার ওপর এক ধরনের শ্যেনদৃষ্টি ও কায়েমি স্বার্থ রয়েছে।
 
১৯৯১ সালের বেতনস্কেলে অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের বেতন একধাপ কমিয়ে দেওয়া হয়। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আবেদন সংগ্রামের পর ১৯৯৪ সালে তা পুনঃনির্ধারিত করা হয়। কিন্তু, ১ মাস ২০ দিন পরই তা আবার স্থগিত করে দেওয়া হয়। স্থগিত করার অর্থ হলো সেটা বাতিল হয়নি, এখনো বিবেচনায় আছে, কিন্তু তার ফল ভোগ করা যায় না। সেটা বাতিল হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। আবার, পুরোপুরি বাতিল না হলে মামলা করা বিধেয় না। তারপর ২ নভেম্বর ১৯৯৫ তারিখে সেটা একেবারেই বাতিল করে দেওয়া হয়। এতে বিচারকদের বেতন কমে যায়। বেতন কমানো সরকারি চাকরির আর্থিক পদ্ধতির লঙ্ঘন। এভাবে দীর্ঘ ১ বছর ৯ মাস ধরে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য বিচারকরা সরকারের প্রশাসনিক পর্যায়ে আইন, সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত দিয়ে চেষ্টা-তদবির করছিলেন। বেতন কমে যাবার প্রতিবাদে শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন নামের একজন বিচারক ১৬ মাস বেতন গ্রহণ করেননি। বিচারকরা কালো ব্যাজ ধারণ করেন এবং পরপর ২ দিন ১ ঘণ্টার জন্য প্রতীকী ‘কলমবিরতি’ পালন করেন (মাসদার হোসেন, ডেইলি স্টার, ২০১৭)।
 
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যাপারটি তোলার জন্য তার অফিসে গেলে মুখ্যসচিব সাক্ষাৎ করতে দেননি এবং অশোভন ব্যবহারও করেছিলেন বিচারকদের সঙ্গে। এরপর তৎকালীন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজের কাছে গেলে তিনি আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিদায় করেন বিচারকদের। (গোলাম মর্তুজা মজুমদার, আইন ও বিচার সাময়িকী, ২০২৪)। এ দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষেই আর কোনো বিকল্প প্রতিকারের পথ না থাকায় এক রকম বাধ্য হয়েই দায়ের হয় মাসদার হোসেন মামলা।
যে বৈষম্যের প্রতিকার চাইতে গিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল বিচারকদের, সেটা ঘটে চলছিল স্বাধীনতার ২৭ বছর পরও। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য সংবিধানে যেসব নির্দেশনা ঘোষিত হয়েই ছিল, সেগুলোকে বাস্তবায়ন করতে সরকারগুলো অস্বীকৃতি জানায়।

মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বিরুদ্ধে যে প্রধান অভিযোগটি শোনানো হয় সেটি হলো সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার কথা বলা আছে, কিন্তু সেটা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি যা আদালতের মাধ্যমে বলবত করা যায় না। প্রকৃত সত্য হলো মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নির্দেশ আদালত ২২ অনুচ্ছেদের আওতায় দেননি, দেওয়া হয়েছে সংবিধানের ৪র্থ তফসিলের অন্তর্গত ‘অন্তবর্তীকালীন ও সাময়িক বিধানাবলীর ৬ (৬) উপদফার দির্দেশনা অনুযায়ী। এ উপদফাটি কোনো ধরনের সংশোধন ছাড়াই এখনো বহাল আছে। তাতে বলা আছে—
‘অধস্তন আদালত সম্পর্কিত এ সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের ২য় পরিচ্ছেদের বিধানাবলী যথাশিগগিরই সম্ভব বাস্তবায়িত করা হইবে।’

কেউ কেউ যেমন বলার চেষ্টা করেন, মাসদার হোসেন মামলার রায়টি সেরকম একতরফা ছিল না। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় মামলায় জবাব দেয়। তারপরও, এ মামলার সঙ্গে সাংবিধানিক নানা প্রশ্ন জড়িত থাকায় আদালত নিজ উদ্যোগে অ্যাটর্নি জেনারেলকে সরকারের বক্তব্য জানানোর জন্য নোটিস দেওয়া হয়। এরপর, অ্যাটর্নি জেনারেল সরকার পক্ষে শুনানিতে উপস্থিত থাকেন এবং একপর্যায়ে আদালতে জানানো হয় যে, অ্যাটর্নি জেনারেল রিটকারীদের দাবি যৌক্তিক মর্মে লিখিতভাবে মতামত জানান। এটা এখন ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, পরবর্তীকালের অ্যাটর্নি জেনারেলদের মতো সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকেননি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব কে এস নবী। তিনি সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে তার সাংবিধানিক ম্যান্ডেট বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে রাষ্ট্র ও সংবিধানকেই সমুন্নত রেখেছিলেন। কিন্তু সরকার তার মতামত অনুযায়ী কাজ না করায় আদালত রায় দেন।

অনেক সময় রায়-আদেশ ইত্যাদি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বলতে দেখা যায় ১২ দফা নির্দেশনা বাধ্যতামূলক নয়। এমন বক্তব্য তথ্য হিসেবে যেমন ডাহা মিথ্যা, তেমনই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা, যা গুরুতর আদালত অবমাননার বিষয় হতে পারে। আপিল বিভাগ ১২ দফা রায়ের ‘অপারেটিভ পার্ট’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছেন। রায়ের যে অংশগুলো আদেশাত্মক বা বাধ্যতামূলক, সেগুলোই ‘অপারেটিভ পার্ট’। তাই এগুলোর বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। সাংবিধানিক প্রত্যাদেশের কারণে মাসদার হোসেন মামলার রায় যদি নাও থাকত, তবুও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণে বাধ্য ছিল সরকার।

সংবিধানের নির্দেশনা হলো বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। অন্যদিকে, ম্যাজিস্ট্রেসি গঠিত হয় ফৌজদারি কার্যবিধির মাধ্যমে। এ ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায়ই ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের, যা সুস্পষ্টভাবেই বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক প্রত্যাদেশের লঙ্ঘন। এ কারণে বিচারকদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অর্পণ করার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করা আবশ্যক ছিল। রায়ের ৫ ও ৬ নং নির্দেশেই পৃথকীকরণসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের কথা বলা আছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো সংবিধানের ১১৫ ও ১৩৩ অনুচ্ছেদেই এসব বিধিমালা প্রণয়নের এখতিয়ার দেওয়া আছে।

সংবিধান অনুযায়ী নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূত ছিল এবং বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নীতিনির্ধারণী বিষয়, তাই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছে বলে যেসব বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, সেগুলোর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সরকারের মামুলি নীতিনির্ধারণী বিষয় নয়, তার চেয়ে অনেক উপরস্থ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়। সে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সরকারগুলো পালন করতে ব্যর্থ হওয়াটাই ছিল অসাংবিধানিক। ১৯৭২-এর পর থেকে ২০০৭ এর মধ্যবর্তী প্রতিটি সরকারই এ অসাংবিধানিকতার জন্য দোষী। সে কারণেই সর্বোচ্চ আদালত বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেই নির্দেশ দিয়েছেন যে বিচার বিভাগ পৃথক না করার কারণে সংবিধানের লঙ্ঘন হচ্ছে, তা অবিলম্বে পালন করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। তদুপরি আদালতের নির্দেশ পালন সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলীর অংশ, নীতিনির্ধারণী বিষয় নয়।

মামলা বাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ২০২৩ সালে এ দেশের মাত্র ২১০০ বিচারক মিলে ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ১২৩টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। তারপরও মামলা জমে যায়। কারণ মামলা দায়ের হয়েছে তার চেয়েও বেশি। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে। নিত্যনতুন ধরনের অপরাধ জন্ম নেওয়ার কারণে নতুন নতুন আইন হচ্ছে। সেসব আইন মামলা বাড়ছে। তদুপরি, বিচার বিভাগ মামলা করে না। তাই মামলা বাড়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। মামলা বাড়ার সূতিকাগার হচ্ছে দেশের ভূমি প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা। চরম অদক্ষতা ও নানা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে প্রতিটি ভূমি জরিপ, নামজারি, জমা-খারিজ, বন্দোবস্ত, ভূমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি সম্পন্ন করার অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব কারণে জন্ম নেয় লাখ লাখ দেওয়ানি মামলা। আর ভূমি বিরোধ থেকে জন্ম নেয় ব্যক্তি-পারিবারিক-গোষ্ঠীগত বিরোধ, মারামারি, খুনাখুনির মতো অপরাধ, যার উপজাত হিসেবে উৎপন্ন হয় অজস্র ফৌজদারি মামলা। এর বাইরে, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হয়রানি ও দমনপীড়নের জন্য আইন-আদালতকে টুলস হিসেবে ব্যবহারের যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে তাতে জন্ম নিয়েছে কয়েক লাখ ‘গায়েবি’, ‘রাজনৈতিক’ ইত্যাদি নামে চিহ্নিত মিথ্যা মামলা। অথচ এর সব দায় বহন করতে হয় বিচার বিভাগকে।

সুদীর্ঘ বিচারিক সংগ্রামের ভেতর দিয়েই বিচারকদের জন্য আলাদা বেতনস্কেল নির্ধারণ করা হয়েছে। সত্য যে, তা বাংলাদেশের অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় কিছুটা বেশি। যদিও জুডিসিয়াল পে কমিশন বিচারকদের যতটুকু বেতনভাতা দেওয়া আবশ্যক বলে সুপারিশ করেছে, তার তুলনায় অনেক কম বেতনভাতা দেওয়া হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার বিচারকদের তুলনায়ও কম সেটা। পৃথিবীর সব সভ্য দেশে বিচারকদের কাজের জটিলতা ও তাতে বিনিয়োগ করা শ্রম বিবেচনায় তাদের বাড়তি বেতনভাতা দেওয়া হয়। আমাদের দেশ এর বাইরে নয়।

বিচারকদের গৃহঋণ ও গাড়িঋণ সুবিধা দেওয়া হয় সবার শেষে ও তুলনামূলক দীর্ঘ চাকরিকালের পর। বিচারকদের পর্যাপ্ত বাসস্থান না থাকায় বেসরকারি ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। সব সরকারি অফিস বিভিন্ন পর্যায়ের ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এলেও বিচার বিভাগে এর ছোঁয়া পড়েনি বলা যায়। ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক কাজ, সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আইন প্রণীত হলেও প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও লোকবল না থাকায় ভার্চুয়াল আদালত চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। সার্বিক বিবেচনায় বিচারকদের চেয়ে কর্ম ও পদমর্যাদায় নিম্নস্তরের সরকারি কর্মকর্তাদেরকেই অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে দেখা যায়।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ২০০৭-এর ১ নভেম্বরের পর থেকে বিচার বিভাগ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনেকাংশেই সফল হতে পারেনি। ফলে, জনগণ ইপ্সিত প্রতিকার পেতে সমর্থ হয়নি। এর কারণই হলো বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করতে দেওয়া হয়নি। এর কুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছে জনগণ। ৫ আগস্ট মতান্তরে ৩৬ জুলাই ২০২৪ তারিখে জনগণ সেই রাষ্ট্রকাঠামোকে উৎখাত করেছে। তাই এখনই সময় জনগণকে তাদের হক বুঝিয়ে দেওয়ার, ইনসাফ কায়েম করার। এর জন্য সবার আগে দরকার বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথককরণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এজন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য সরকারের বাইরের একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার।

লেখক : সংবিধান ও আইন বিষয়ে লেখক ও গবেষক

কেকে/এএম
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

৬ সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বাড়লো
শহিদ আসাদ দিবসে ৯০-এর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের শ্রদ্ধা
মাশরাফি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার সংবাদটি গুজব
ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান রাত ১১টায়
সুগার মাম্মি হতে চাই: সুবাহ

সর্বাধিক পঠিত

সুফলে সেজেছে জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ
আদিতমারীতে ছাড়পত্রহীন ৪টি ইট ভাটায় জরিমানা
বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ কি আদৌ হয়েছে
কুষ্টিয়ায় বড় ভাই হত‌্যা মামলায় ছোট ভাইসহ গ্রেফতার ৪
গণমাধ্যমকে অবশ্যই পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে: জুনায়েদ সাকী

মুক্তমত- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝