চলতি বছরের ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। এমনটাই জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরীণ একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। এর আগে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও তেমনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচন কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন বা পুনর্বহালের বিষয় নয়; বরং এটি গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।
শফিকুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি সংস্কার না চাইলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নির্বাচনের সময় নির্ভর করছে আমাদের অংশীজনদের চাওয়ার ওপর। আমাদের সঙ্গে সংলাপে তারা তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করবেন, কতটুকু সংস্কার তারা চান। সংস্কার একটা দেশের জন্য চলমান প্রক্রিয়া।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বারবার এ বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, যদি কম সংস্কার হয় তাহলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা হবে। আর যদি রাজনৈতিক দলগুলো বা অংশীজনরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আরো বেশি সংস্কার চায় তাহলে এটা আরো ছয় মাস লাগতে পারে। একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও সংস্কার কমিশনগুলো আলোচনা করবে। এ আলোচনার ওপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
জানা যায়, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তে যাচ্ছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকে ‘যৌক্তিক সময়ের’ মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করে আসছিল বিএনপি। তবে দেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সে জায়গা থেকে সরে এসে চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলেছে দলটি। তাদের দাবি, একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। সরকারের পক্ষ থেকে ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন আয়োজনের ইঙ্গিত দেওয়া হলেও, এখনো এর কার্যকর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অভাব রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা ইতিবাচক হলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে আসতে পারে। তারা মনে করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু না হয়, তবে জনগণের আস্থা আরো কমে যেতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারের উচিত কূটনৈতিক দক্ষতা দেখান।
জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার খোলা কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচন কবে হবে তা সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ হতে পারে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কবে হবে তার কোনো রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সরকারের জন্য অসম্ভব কিছু না। এ বিষয়ে রাজনীতিবিদরাই ভালো বলতে পারবেন।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিভিন্ন কাজ এক-দুই মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে এবং গভর্ন্যান্সের মধ্যে মোটামুটি একটা স্ট্যাবিলিটি (স্থিতিশীলতা) এসেছে। সুতরাং মনে হয় না নির্বাচন আরো বিলম্বিত করার কোনো কারণ আছে। যত বিলম্ব হচ্ছে, ততই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খোলা কাগজকে বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের গতি তারা যদি বাড়াতে পারে ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যেই সংস্কার নিয়ে যাবতীয় আলাপ-আলোচনা সম্পন্ন করে ফেলা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকার খসড়া তালিকা দিয়েছেন, এরপর যে কাজ ছয় মাসের সে কাজ দুই মাসের মধ্যেও করা সম্ভব। মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন কমিশন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা যাচাই করার কাজ শেষ করতে পারে। এরপর বাকি যে আলোচনা আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে সম্ভব।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। অতীতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, অস্থিরতা এবং অসন্তোষ দেখা গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে। অধ্যাপক ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এ সরকারের সীমাবদ্ধতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ তাদের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এ বিষয়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিক সাইফুল হক বলেন, ‘নির্বাচন করার বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলব না। কিন্তু নানা কাজের কারণে সরকার নির্বাচন বিলম্বিত করার দিকে যাচ্ছেন কি-না সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ২০২৬ সালে যাওয়ার দরকার নেই, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। এ নির্বাচনের জন্যই মানুষ ১৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছে।’
সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এক উত্তাল সময় পার করছে। চলমান রাজনৈতিক সংকট, নানা চক্রান্তের আন্দোলন এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে দেশের স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নানামুখী ষড়যন্ত্র এ সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে। এর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভূমিকা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন গতকাল বলেছেন, ‘৫ আগস্টের বিপ্লব আমাদের একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। অনেক সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগটা হচ্ছে নাগরিকদের সুযোগের মধ্যে নম্বর ওয়ান ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ। এই প্রতিষ্ঠার কাজটা করতে প্রথম ধাপ হচ্ছে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা। আমাদের ভোটের ট্রেন যখন যাত্রা করল, এ যাত্রার মধ্যে প্রথম কাজটা হলো ভোটারদের সঙ্গে নিতে হবে এবং সঠিক ভোটার তালিকা না করতে পারলে আমাদের সঠিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হবে। আমরা অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পুরো দেশবাসীকে পাশে চাই।’
তবে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে দু-একটি রাজনৈতিক দলের। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন মনে করে, কাক্সিক্ষত সংস্কার ছাড়া তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে আত্মঘাতী। এর মধ্য দিয়ে আগের ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরার পথ সুগম করবে।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচনে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পূর্ণ হবে না। আবার রাষ্ট্রকাঠামোর পুরোপুরি সংস্কার করা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, এটাও আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু নির্বাচনটা নিরপেক্ষ করতে যতটুকু আইনকানুন সংস্কার সম্ভব, সেটা করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাই। আমরা ১৫ বছর অপেক্ষা করেছি। এখন তিন-পাঁচ মাস বেশি লাগলেও জাতি কাক্সিক্ষত সংস্কার শেষে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘বিএনপি তার জায়গা থেকে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার এবং নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরির জন্য দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া।’
তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, যদি নির্বাচন কমিশন, দুদকসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার সম্পন্ন হয়। সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাই। কিন্তু সেটা অবশ্যই হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন। এ মুহূর্তে গণপরিষদ নির্বাচন হচ্ছে নির্বাচনের একমাত্র যৌক্তিক পন্থা।’
কেকে/এমএস