ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাকর্মীই দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে ফোনালাপ এবং বিবৃতির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রকাশ্যে আসতে দেখা গেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। যদিও যোগাযোগ বলতে ফোনালাপ, অডিও কল রেকর্ড ফাঁস এবং বিবৃতির মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে নানা নির্দেশনা প্রদান করা।
নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার নামে এসব ফোনকলে যেসব নির্দেশনা দেন হাসিনা তা আসলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জীবন বিপদের মধ্যে ফেলেছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি-মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাছাড়া ওইসব ফোনকলে অন্তর্বর্তী সরকার পতনের নির্দেশনা রয়েছে। যা দেশকে অস্থির করার ষরযন্ত্র বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
যদিও সম্প্রতি বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হতে দেখা গেছে। কয়েকদিন আগে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার আরো একটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। যেখানে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার কথা শেয়ার করেন। শেখ হাসিনা বলেন, মাত্র ২০-২৫ মিনিটের ব্যবধানে তারা একটি হামলার শিকার হতে পারতেন। যা তাদের জীবন শেষ করে দিতে পারত। এসময় তাকে আরো বলতে শোনা যায়, আল্লাহর রহমতেই তারা প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।
এছাড়া ওই ফোনকলে নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়েছেন হাসিনা। এসময় তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকেই (নেতাকর্মী) মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন ও হরতাল ডেকে হলেও ভ্যাট-টেক্স বন্ধ করতে হবে। সেইসঙ্গে ইউনূসকে (ড. ইউনূস) পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে।’
নেতাকর্মীদের ছেড়ে গেছেন
‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব না’; ‘আমি আত্মগোপনে আছি, ফোনে কথা বলতে পারি’; ‘নিরাপদ কোনো স্থানে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করব’; ‘আপনার গতিবিধি নজরদারি করা হবে, তাই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব কি না, জানি না’। এগুলো ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ তার দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ও সাবেক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সদস্যদের পাঠানো কিছু বার্তা; যা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পেয়েছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গত এক সপ্তাহে এ ব্যক্তিদের কারও কারও সঙ্গে অজ্ঞাত স্থানে দেখা করতে এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিশোধের শিকার হওয়ার শঙ্কায় আত্মগোপনে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়েছে।
এই ব্যক্তিদের অভিন্ন কথা, ‘শেখ হাসিনা দল ও জনগণকে পরিত্যাগ করেছেন।’ তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘আপা (হাসিনা) আমাদের ছেড়ে গেছেন।’
বিপদে নেতাকর্মীদের জীবন
এভাবে শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার ঘটনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জীবন বিপদের মধ্যে ফেলেছে। ‘বিক্ষোভকারী, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং সুযোগসন্ধানীরা’ আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দলীয় কার্যালয়গুলো নিশানা বানান। করা হয় অগ্নিসংযোগ, লুট; চালানো হয় ভাঙচুর। আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘(৫ আগস্ট শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর) আমরা একটা সময়ই শুধু বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাই। সেটি সেনাপ্রধান যখন বেলা তিনটার দিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ও মানুষ তা শুনতে টেলিভিশনের পর্দায় নজর রেখেছিলেন।’ আরেক নেতা ও মন্ত্রী (সাবেক সরকারের) বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা ধরা পড়লে লোকজন আমাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারতেন।’বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন।
পরীক্ষার হল থেকে ছাত্রলীগ কর্মী আটক
পরীক্ষা দিতে এসে এক ছাত্রলীগ কর্মী আটক হন। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ১৯ জানুয়ারি এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় অংশগ্রহণকারী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের এক নেতাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে শাখা ছাত্রদলের পদবঞ্চিত ও সদ্য বহিষ্কৃত নেতাকর্মীদের একাংশ। আটককৃত শিক্ষার্থী শাখা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটির সদস্য শরীফুল ইসলাম সোহান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯ ব্যাচের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের আবাসিক ছাত্র।
শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলা আ.লীগ নেতা গ্রেফতার
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর কবিরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। গত ১৪ আগস্ট বরগুনা পৌরসভার আমতলার পাড় নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার পর বরগুনায় বিশৃঙ্খলা এবং প্রতি বিপ্লবের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে এ অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার ১২ আগস্ট রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর কবির। পরে তাদের কথপোকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
জনগণের সামনে যাওয়াই হবে বড় চ্যালেঞ্জ
গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দল হিসেবে জনগণের মুখোমুখি কীভাবে হবে সেটা হচ্ছে দলটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ বলছে, কর্মসূচির মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হওয়ার কথা। সেরকম পরিস্থিতিও দেখছেন না দলের নেতারা। যদিও বাস্তবে দলটির জন্য নানা চ্যালেঞ্জ দেখছেন বিশ্লেষকরা। এক. প্রশাসনিক বাধা, গ্রেফতার এবং মামলার আতঙ্ক আছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। দুই. অভ্যুত্থানের পর দলটির ভঙ্গুর সাংগঠনিক কাঠামো। তিন. দলীয় নেতাদের অনুপস্থিতি। চার. গণহত্যার অভিযোগ। তবে এসবের মধ্যেই রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেন, দলটি জনগণের মুখোমুখি কীভাবে হবে তা নিয়ে।
‘চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে কীভাবে আবার দাঁড়াবে। কী কৌশল নিয়ে দাঁড়াবে, কী বার্তা নিয়ে দাঁড়াবে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে দাড়াবে এবং কী কর্মসূচি নিয়ে দাঁড়াবে। আবার জনগণের সামনে আসলেও জনগণ তাদের বার্তাকে কীভাবে নেবে সেটা দেখার বিষয়,’ বলেন জোবাইদা নাসরীন। তার মতে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তাদের জন্য পরিস্থিতি এখন বেশ কঠিন।
আওয়ামী লীগের জন্য বাস্তবতা প্রতিকূল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি গত ৫ অগাস্টের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার মতো দাবিও উঠেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। যদিও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আবার এর বিরোধিতাও করেছে। তবে আদালতে জুলাই গণহত্যার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারিকভাবেই নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি আছে আওয়ামী লীগের। ফলে তেমন পরিস্থিতিতে পড়ার আগেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মতো সাংগঠনিক অবস্থা তৈরি করতে চায় আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় ‘জনরোষ এখন সময়ের ব্যাপার’। ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে মাঠে নামার পর সেখানে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলেই আশাবাদী আওয়ামী লীগ। যদিও রাজনীতির জটিল সমীকরণ যে এতো সরলভাবে মিলে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কেকে/এমএস