সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা বাহিনীর আধুনিকায়ন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর নতুন পোশাকের ব্যাপারে সংস্কার কমিটি প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাহ্যিক পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের পেশাদারত্ব ও মানসিকতায় যথাযথ পরিবর্তন আসছে কি? কারণ, শুধু পোশাক নয়, একজন পুলিশ সদস্যের দায়িত্ব পালনের গুণমান নির্ভর করে তার মনোভাব, দক্ষতা এবং জনগণের প্রতি সেবামূলক মনোভাবের ওপর।
জুলাই-আগস্টে সবথেকে গণহত্যা এবং অত্যাচার চালানোর অভিযোগ পুলিশের ওপর। তবে বিভিন্ন দুর্নীতি, সরকারি দলের প্রভাব ও নানা কারণে জনগণের আস্থার জায়গা হারিয়ে ফেলেছে অনেক কারণে। ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে তাই পুলিশে সংস্কার অন্যান্য সব বাহিনীর থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারই ফলে বাংলাদেশ পুলিশসহ ৩ বাহিনীর পোশাক পরিবর্তন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে জনগণের চাওয়া পোশাকের পাশাপাশি পুলিশের পেশাদারী আচরণ।
পুলিশের পোশাক বাহিনীর পরিচিতি ও কর্তৃত্বের প্রতীক। এটি আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং শৃঙ্খলা প্রকাশ করে। কিন্তু একে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হলে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। যদি একজন পুলিশ সদস্য দুর্নীতিপ্রবণ হন বা জনসেবা নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহারে আগ্রহী হন, তাহলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোশাকও তার ভাবমূর্তি উন্নত করতে ব্যর্থ হবে।
বাংলাদেশ পুলিশের বড় একটি অংশ এখনো সেবার চেয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনে বেশি আগ্রহী। এ ছাড়া জনগণের সঙ্গে তাদের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই কঠোর এবং অমানবিক বলে অভিযোগ উঠে। দমনমূলক মনোভাবের কারণে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছে। দাফতরিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বিলম্বিত সেবা প্রদান এবং ঘুষ গ্রহণের মতো অভিযোগও তাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে পড়েন। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে তারা প্রায়ই ব্যর্থ হন।
মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য কী করা প্রয়োজন? পুলিশকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা জনগণের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহমর্মী আচরণ করতে শেখে। প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন করা উচিত। পুলিশের মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ বাহিনীতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি পেশাদারত্ব উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধ তদন্ত, কৌশলগত চিন্তা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রতিটি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব। পেশাদার নেতৃত্ব একটি বাহিনীর মানসিকতা ও কাজের মান উন্নত করে। তাই পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ববান ও নৈতিকতাসম্পন্ন নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, পুলিশের মানসিকতা ও পেশাদারত্বে ইতিবাচক পরিবর্তন এলে জনগণের আস্থা বাড়বে। এর ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা আরো সহজ হবে এবং অপরাধ দমন কার্যক্রমে কার্যকরী ফলাফল আসবে। পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর প্রয়াস। তবে এটি শুধু বাহ্যিক পরিবর্তন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর প্রকৃত আধুনিকায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের পেশাদারত্ব ও মনোভাবের আমূল পরিবর্তন। এ পরিবর্তন কেবল বাহিনীকে আরো দক্ষ ও জনমুখী করবে না, বরং একটি নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ার পথও প্রশস্ত করবে।
লেখক : সমাজকর্মী ও কলামিস্ট।
কেকে/এএম