জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, সেনাপ্রধান, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, সেই সঙ্গে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা পরিচালিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ২০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে জিয়াউর রহমানের নাম ১৯ নম্বরে উঠে আসে।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জিয়াউর রহমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম (‘পরম করুণাময়, অসীম দয়াবান আল্লাহর নামে’) সন্নিবেশ করার জন্য সংবিধান সংশোধন করে একটি রাষ্ট্রপতি আদেশ জারি করেন। অনুচ্ছেদ ৮(১) এবং ৮(১অ) তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ নীতি যোগ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৮(১), সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৫(২)-এ এটাও বলা হয়েছে যে ‘রাষ্ট্র ইসলামি সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সুসংহত, সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।’
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নিজেকে চেয়ারম্যান করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি ৩০০টির মধ্যে ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনগণের একটি নতুন জাতীয় পরিচয় হিসেবে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রবর্তন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশের মতো একটি বহুবচন সমাজে যেখানে মানুষ বিভিন্ন জাতিসত্তার এবং যেখানে তারা বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস করে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন জীবনধারা রয়েছে, সেখানে জাতীয়তাবাদকে ভাষা বা সংস্কৃতির পরিবর্তে ভূখণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা উচিত। এ বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, সংস্কৃতি এবং জাতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব নাগরিকের জাতীয় ঐক্য এবং একত্রীকরণের ওপর জোর দেয়।
জিয়া সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছিলেন, কিন্তু ভিন্নধর্মী স্বার্থের অস্তিত্ব ও পরিচালনার কারণে তিনি একটি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যারা বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ এবং অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিলেন, যারা শিষ্যদের উপেক্ষা করে তাদের বিরুদ্ধে কিছু আপসহীন এবং কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন। সেই বিদ্রোহে অংশ নেন।
উচ্ছৃঙ্খল সেনাবাহিনীর মাঝে জিয়া দৃঢ় ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে দেশ যত তাড়াতাড়ি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে যাবে ততই নিজের এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক। তিনি নির্বাচনের প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধার করে এবং এভাবে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সহজতর করে রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক করার জন্য যতটা দ্রুত সম্ভব অগ্রসর হন। তার লক্ষ্যের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, জিয়া ভেঙে পড়া ও বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার অনুমতি দেন এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবারও চলতে দেন। ফলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবারও রাজনীতি করার সুযোগ পায়।
এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে জিয়া সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তথ্য মাধ্যমকে মুক্ত ও নিরবচ্ছিন্ন করে সংবাদের অবাধ প্রবাহের উদ্বোধন করেন। বিরাজমান পরিস্থিতি তাকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিতে প্ররোচিত করে। তিনি বিশ্বাস করেন, স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধার করে এবং দলগুলোকে স্বাধীনভাবে অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করেন।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তারিখে ব্রিটিশ বেঙ্গলের বগুড়া জেলার নশিপুর ইউনিয়নের বাগবাড়ী গ্রামের মণ্ডল বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তার পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দফতরে রসায়নবিদ রূপে কর্মরত ছিলেন। তার ডাক নাম ছিল কমল।
জিয়াউর রহমানের মূল পূর্ব পৈতৃক নিবাস বগুড়ার মহিষাবান গ্রামে। তবে দাদার বিয়ের পর পরিবারটি বাগবাড়ী গ্রামে বসতি স্থাপন করে। গাবতলী, সুখানপুকুর ও যমুনার পশ্চিম তীরবর্তী এলাকার বিখ্যাত নেতা মুমিন উদ্দিন মণ্ডল মহিষাবানী এবং উনার তৃতীয় অধস্তন আওলাদ কাঁকর মণ্ডল সাহেবের সরাসরি বংশধর জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের দাদা মৌলবী কামালুদ্দীন মণ্ডল ছিলেন কাঁকর মণ্ডল সাহেবের একমাত্র পুত্র এবং বাগবাড়ী মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
১৯৬০ সালে দিনাজপুর শহরের বালিকা, খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর খালেদা খানম থেকে খালেদা জিয়া বা বেগম খালেদা জিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাদের দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো।
শিক্ষাজীবন
তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা নগরীতে অতিবাহিত হয়। ভারতবর্ষ বিভাগের পর তার পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি নগরীতে চলে যান। তখন জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। ওই বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং তারপর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ডি. জে. কলেজে ভর্তি হন। শিক্ষাজীবনে উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করায় তিনি বাংলায় কথা বলতে পারলেও সাবলিলভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে পারতেন না। ১৯৫৩ সালেই তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট রূপে যোগদান করেন।
সেনাবাহিনীতে জিয়া
১৯৫৩ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুলস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদবিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হন। সামরিক বাহিনীতে তিনি একজন সুদক্ষ ছত্রীসেনা ও কমান্ডো হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। করাচিতে দুবছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে স্থানান্তরিত হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিল এদের অন্যতম। এ যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। এ ছাড়া জিয়াউর রহমানের ইউনিট এ যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত পদক লাভ করে।
১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটাস্থিত কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদবিতে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব লাভ করেন। অ্যাডভান্সড মিলিটারি অ্যান্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্স নামক একটি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান এবং কয়েক মাস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গেও কাজ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব লাভ করেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্ব
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালায়। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত।
মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তারপর ২৬ মার্চ বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের সহায়তায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক মেজর জিয়া এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
জিয়াউর রহমান ও তার সৈন্যরা এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখভাগে আসেন। মেজর জিয়া এবং তার নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকাকে কয়েকদিন তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাপের মুখে কৌশলগত পশ্চাদপসরণ হিসেবে সীমান্ত অতিক্রম করে।
জিয়াউর রহমান প্রাথমিকভাবে বিডিএফ সেক্টর ১-এর বাংলাদেশ ফোর্সেস কমান্ডার হয়েছিলেন এবং জুন থেকে বাংলাদেশ বাহিনীর বিডিএফ সেক্টর ১১-এর বিডিএফ কমান্ডার এবং ১৭৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে জেড ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়, ২৮ আগস্ট, ১৯৭১ সালে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে পুনরুদ্ধার করা রৌমারীতে প্রথম বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্ব পুরস্কার ‘বীর উত্তম’-এ ভূষিত হন।
স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক পেশা জীবন
স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৪তম ব্রিগেডের কমান্ডার নিয়োগ করা হয় যে ব্রিগেডের সদস্যরা তারই অধীনে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। ’৭২-এর জুন মাসে তিনি কর্নেল পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ (উপ সেনাপ্রধান) নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে, ওই বছরের অক্টোবরে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল করেন এবং নিজেও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবি গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রদান করে তা জনপ্রিয় করে তোলেন। বাংলাদেশে বহুসংখ্যক বিভিন্ন ধরনের মতের ও ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন একে অপরের থেকে ভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এ ধারণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান।
আইনশৃঙ্খলা
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তিশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও জিয়াউর রহমানকে বেশ কয়েকটি সেনা-বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
বহুদলীয় গণতন্ত্র
নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং অবাধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতির গণতন্ত্রায়ণে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এভাবে, তিনি সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন।
১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং রাষ্ট্রপতির পদে নিয়োজিত থাকেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এ দলের চেয়ারপারসন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এ দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এ দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়ার এই দলে বাম, ডান ও মধ্যপন্থিসহ সব স্তরের লোক ছিলেন। বিএনপির সব থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি। প্রায় ৪৫ শতাংশ সদস্য কেবল রাজনীতিতে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যদের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আব্দুল মালেক উকিল এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে।
অর্থনৈতিক সংষ্কার
রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান অন্য একটি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এটা জাতীয় অর্থনীতি। জিয়ার অর্থনৈতিক নীতি প্রাইভেট সেক্টরের উন্নয়নের ওপর জোর দেয়, যা আগে অবহেলিত ছিল। তিনি বিশেষজ্ঞদের একটি দলকে বেসরকারি খাতের উন্নয়নের প্রচারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের উপায় এবং উপায় পরিকল্পনা করতে নিযুক্ত করেন এবং কৃষকদের ভর্তুকি এবং কৃষি বিপণনের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের সূচনা করেন।
তিনি জাতীয়করণকৃত শিল্পগুলোকে তাদের সাবেক মালিকদের কাছে হস্তান্তরের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রফতানি খাতের উন্নয়নে তিনি প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্য রফতানির প্রসারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জিয়ার অর্থনৈতিক নীতি তাকে যথেষ্ট সাফল্য এনে দেয়। খাদ্য উৎপাদন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে চালের উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল।
জিয়াউর রহমানের কর্মপরিকল্পনায় একটি ১৯-দফা কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত ছিল যা দেশে দ্রুত আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ওপর জোর দেয়। উন্নয়ন প্রচেষ্টায় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক রূপান্তর এবং স্বনির্ভরতা ও গ্রামীণ উন্নয়ন সাধনই ছিল এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কৃষি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং বেসরকারি খাতে বৃহত্তর প্রণোদনা। এটি জনগণের মৌলিক চাহিদা এবং নারী, যুবক এবং শ্রমিকদের বিশেষ চাহিদা মেটাতেও পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং এটির লক্ষ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
তার অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য, রাষ্ট্রপতি জিয়া দেশের রাজনীতিকে একটি উন্নয়নমুখী রাজনীতিতে রূপান্তর করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও তাত্ত্বিকভাবে এমন একটি স্বপ্ন নিঃসন্দেহে খুবই দুর্বল ছিল। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন নয়। এর আরও অনেক প্রভাব রয়েছে। তিনি কর্মসূচিগুলোকে বিপ্লব হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং তার দলের লোকদের উন্নয়ন অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই কর্মসূচিগুলো উপলব্ধি করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল খাল খনন এবং এটি কৃষকদের পর্যাপ্ত জল সরবরাহ করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বিশেষত খরা মৌসুমে।
দ্বিতীয়টি ছিল সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা যাতে সমাজের সব স্তরে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত বাতাসের উদ্ভব হয়। অধিকন্তু, মাঠ ও কারখানা উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদন ত্বরান্বিত করার জন্য প্রেরণামূলক কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে তীব্র করা, যা ছিল বৈপ্লবিক, জনসংখ্যাকে এমন একটি স্তরে স্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল যা অর্থনৈতিক এবং টেকসইতার দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোত্তম বলে অভিহিত করা যেতে পারে।
গ্রাম সরকারের প্রতিষ্ঠান (গ্রাম সরকার) একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশের জন্য জনগণের সমর্থন তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে, যা জিয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে ওঠে। তার কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল যে তিনি এটিকে শুধু ভোটের স্লোগানে পরিণত করেননি। তিনি তার কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। দেড় বছরে ১৫০০টিরও বেশি খাল খনন ও পুনঃখনন, পরপর দুই বছরে (১৯৭৬-৭৭ এবং ১৯৭৭-৭৮) খাদ্যশস্যের রেকর্ড উৎপাদন, ১৯৭৬-৭৮ সালে গড় বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ, একটি জোরালো গণশিক্ষা অভিযান, গ্রাম সরকার এবং গ্রাম প্রতিরক্ষা পার্টির (ভিডিপি) প্রবর্তন জনগণের মনে গভীর ছাপ ফেলে। দাতা সংস্থাগুলোও তার সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
মৃত্যু
সেনাবাহিনীতে জিয়া অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। অনেক উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বিপদের সমূহ সম্ভাবনা জেনেও জিয়া চট্টগ্রামের স্থানীয় সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে ঘটিত কলহ থামানোর জন্য ১৯৮১ সালের ২৯ মে চট্টগ্রামে যান এবং সেখানে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে থাকেন। তারপর ৩০ মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। জিয়াউর রহমানকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দাফন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ঘটে যেখানে প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ সমবেত হয়।
কেকে/এএম