বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ফুঁসতে থাকা উত্তেজনা প্রকাশ্যে এসেছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় এ উত্তেজনা উভয় দেশের জনমনে গভীর কৌতূহল ও আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটির সম্পর্কের গভীরতা ও জটিলতা যেন তার সব অবয়ব নিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ এমন একটি সম্পর্ক বজায় রাখে সেটি যেমন জটিল তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি অনেক কারণেই ঘটছে এবং এর পেছনে প্রধানত রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়ের জটিলতা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব ভারত নিজের পররাষ্ট্র নীতির দিকে যে পরিবর্তন এনেছে, তা প্রতিবেশী বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশিত ফলাফল এনে দেয়নি। বাংলাদেশ যেখানে লালন করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় সেখানে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণার ক্রমবর্ধমান প্রভাব পররাষ্ট্র নীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তার সহযোগী দলগুলো আঞ্চলিক ঐক্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির চর্চায়। এর ফলে দেশীয় রাজনীতি প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঝুঁকেছে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনকে আরো দৃঢ় করতে বাংলাদেশ সর্বদা বাণিজ্য, সংযোগ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়গুলোতে ভারতকে সহযোগিতা করে এসেছে।
কিন্তু ভৌগোলিক আকার, ক্ষমতা ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের নামে ভারত সর্বদা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব পোষণ করে এসেছে। বিশেষত অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন না হওয়া, কথিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো মূল বিষয়গুলো বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ ও ভারত বৃহৎ সীমান্তের প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘটিত সীমান্ত হত্যা যেন নৈমিত্তিক ঘটনা। আর সবক্ষেত্রে ভিকটিম বাংলাদেশি নাগরিক।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে অন্তত ৬০৭ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। শুধু ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ২০ জন বাংলাদেশি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, নেপাল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড রয়েছে। ভৌগোলিক বৈরী সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো সীমান্তে এরূপ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় না। এ হত্যাকাণ্ডগুলো বলে দেয় বন্ধুত্বের বুলি আওড়ানো সম্পর্ক বাস্তবে মেকি। দেখতে দেখতে ফেলানী হত্যার ১৪ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে কিন্তু ফেলানীর বাবা-মা মেয়ে হত্যার বিচার পায়নি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে ফেলানী হত্যাকাণ্ড ফলাও করে প্রচার হওয়ায় বিএসএফ লোক দেখানো বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আয়োজন করে। সীমান্ত হত্যার কারণ হিসেবে বিএসএফ যেসকল খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করায় তা শুনলে যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ব্রক্ষতালু উত্তপ্ত হয়ে উঠবে ক্ষোভে আক্রোশে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বিশেষ আদালত আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস প্রদান করে। বিশেষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ভারতের ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ সুপ্রিম কোর্টে রিট করে কিন্তু এক দশক পার হয়ে গেলেও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই রিটের নিষ্পত্তি করেনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং ভারতের মালদার শুকদেবপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী(বিএসএফ) কর্তৃক নোম্যানস ল্যান্ডে জোর পূর্বক কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করতে গেলে বিজিবি বাঁধা প্রদান করে। এ নিয়ে উভয় দেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক নোম্যানস ল্যান্ডে জোর পূর্বক কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের চেষ্টা দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কেতাবি দাবির সঙ্গে ঠিক যায় না।
বাংলাদেশ-ভারত সীমারেখা ৪১৫৬.৫৬ কিলোমিটার। যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক সীমানা। যার মধ্যে ৩২৭১ কিলোমিটার স্থানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। দুই দেশের মানুষের ইতিহাস, ভূগোল, ভাবাবেগ, মূল্যবোধ ও স্বার্থের এক অপূর্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে এক বিশেষত্ব দান করেছে। বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক সীমান্তে বিচারবিহীন নারকীয় হত্যাকান্ড বন্ধুত্বের সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। এই সীমান্ত এখন নানা সমস্যার বিষয় হয়ে উঠেছে। যেমন—চোরাচালান, অবৈধ অভিবাসন, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।
হিউম্যান রাইট ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশিদের নির্বিচারে হত্যার প্রেক্ষিতে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভুক্তভোগীকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পেছন থেকে পিঠে গুলি করে বিএসএফ। এযাবৎ সীমান্ত হত্যায় যতগুলো মামলা হয়েছে সে মামলার কোনো তদন্তেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারেনি হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে যার দ্বারা তাদের প্রাণসংহার বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
সুতরাং হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিএসএফের গুলি চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিএসএফের গুলিতে ফেলানী থেকে সর্বশেষ আনোয়ার হোসেনকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে যেভাবে জটিল ও কূটনৈতিক করে তোলা হচ্ছে তাতে করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে সহাবস্থান অনেকটা বিপজ্জনক রূপ লাভ করবে। এমনিতেই আন্তঃসীমান্ত নদনদী নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক আধিপত্যবাদী আচরণ মোটেও সুফল বয়ে আনবে না।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরঞ্চ পরিসংখ্যান বলছে গত কয়েক বছরে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিষ্টাচারের সরকারি যোগাযোগ বজায় থাকলেও সাম্প্রতিক ইস্যুতে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের মনে রাখা দরকার অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরার নিরাপত্তাজনিত ইস্যুর কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্কের বিষয়টি ভারতের উচিত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস সৃষ্টি এবং সম্পর্কোন্নয়নে সীমান্ত হত্যা অবশ্যই শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে।
ভারতীয় নেতাদের বারবার আশ্বাস সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি যন্ত্রণাদায়ক এবং সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হওয়ায় দুই দেশের জনগণের সম্পর্কের ওপর এর খারাপ প্রভাব পড়ছে। ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, যাতে হতাহত ব্যক্তিদের সংখ্যা কমানো সম্ভব হয়। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করেনি, পালটায়নি তাদের আচরণ। সীমান্তে বিএসএফ যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করে ফলে তারা গুলি চালায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর। ভারতের পেনাল কোর্ট কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো আইনে নিরস্ত্র নাগরিককে নির্যাতন করে বা গুলি করে হত্যা করার বিধান নেই।
কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করলে তাকে গ্রেফতার করে বিচার করা যেতে পারে। কিন্তু ভারত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বীকৃত সব আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় প্রটোকল অগ্রাহ্য করে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। এক সময় বলা হতো গরু চোরাচালানকারীদের ওপর গুলি ছোঁড়া হয় কিন্তু এখন তো গরু চোরাচালান বন্ধ তারপরও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো— গরু চোরাচালানকারী হত্যা করা হয় কিন্তু মাদক চোরাচালানকারীরা নিরাপদেই ভারত থেকে বাংলাদেশে মাদক চোরাচালান করতে পারে। অথচ বিএসএফের এক কমান্ড্যান্ট তাদের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন সীমান্তে চোরাচালানের উদ্দেশ্যে যেসব গরু আনা হয় তার সঙ্গে বিএসএফ কর্মকর্তারা জড়িত। বিগত দিনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে সীমান্তের নোম্যানস ল্যান্ডের পাশে যাদের জমি আছে সেগুলোতে কাজ করার সময় কিংবা কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরার সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে অনেক বাঙালিকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
এ পর্যন্ত সীমান্তে যত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তারা কেউই আক্রমণকারী নয়। তাই বাংলাদেশের উচিত হত্যাকান্ডের শুধু প্রতিবাদ নয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচার চাওয়া। যে কোনো রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হয়ে উঠার পেছনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র গুলোর বড় ভূমিকা থাকে তাই ভারতের উচিত নিরীহ মানুষদের সীমান্তে হত্যা না করে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সর্বাগ্রে দরকার বুকের ভেতরে অঙ্কিত সংকীর্ণতাকে মুছে ফেলে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের সার্থকতা সৃষ্টি করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে বিএসএফ যে আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করেছে তার যথাযথ প্রতিবাদ করবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের এ আধিপত্যবাদী আগ্রাসী চেহারার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : প্রভাষক ও প্রাবন্ধিক
কেকে/এএম