ছোট্ট গ্রামটি সবুজে ঢাকা। পাহাড়ের কোলে চুপচাপ পড়ে থাকা এক জগৎ। সেখানে রাজু নামে এক বালক বাস করত। রাজুর স্বপ্ন ছিল একদিন সে এমন কিছু বানাবে, যা সবাইকে চমকে দেবে। বই পড়া আর পুরোনো যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাই ছিল তার নেশা। সবাই তাকে মজা করে বলত ‘বিজ্ঞানী রাজু’।
একদিন গ্রামের বাইরে পাহাড়ের দিকে হাঁটতে গিয়ে রাজু খুঁজে পেল একটি পুরোনো রেললাইন। এর ধারে জং ধরা একটি কেবিন। কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই রাজুর চোখে পড়ল নানারকম যন্ত্রপাতি আর একটি জীর্ণ মানচিত্র। মানচিত্রে লেখা ছিল, ‘উড়ন্ত ট্রেন: মানবজাতির ভবিষ্যৎ’। এই কথাগুলো পড়েই রাজুর মনে আশার ঝলক দেখা দিল। সে ভাবল, যদি এই ট্রেনটি আবার চালু করা যায়, তবে কত কিছু শেখা এবং দেখানোর সুযোগ পাওয়া যাবে।
রাজু ফিরে এল তার প্রিয় রোবট বন্ধু টিনুর কাছে। টিনু ছিল রাজুর হাতে বানানো রোবট, যার বিশেষ ক্ষমতা ছিল যেকোনো সমস্যা সমাধানে সাহায্য করা। রাজু মানচিত্রটি দেখিয়ে বলল, ‘টিনু, আমরা যদি এই উড়ন্ত ট্রেনটা চালু করতে পারি, তবে কেমন হবে?’ টিনু উত্তেজিত গলায় বলল, ‘খুব ভালো হবে! তবে অনেক কাজ করতে হবে, রাজু।’
পরের দিন থেকেই তারা শুরু করল কাজ। কেবিনে পড়ে থাকা পুরোনো যন্ত্রাংশ আর রাজুর সংগ্রহ করা উপকরণ দিয়ে ট্রেনটি মেরামত করা শুরু হলো। তবে একটি বড় সমস্যা ছিল। ট্রেনটি চালানোর জন্য শক্তি লাগবে, যা সাধারণ ইঞ্জিন বা ব্যাটারিতে সম্ভব নয়।
টিনু বলল, ‘আমাদের চাই ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক শক্তি, যা বাতাসে উড়তে সাহায্য করবে।’ রাজু তার বিজ্ঞান বইয়ের সাহায্যে গ্রাম থেকে পুরোনো সোলার প্যানেল, ব্যাটারি, আর ধাতব টুকরো সংগ্রহ করল। গ্রামের মানুষও তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। রাজুর কৌতূহল আর পরিশ্রম দেখে তারা মুগ্ধ হয়েছিল।
অবশেষে ট্রেনটি নতুন করে গঠিত হলো। রাজু ও টিনু পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেনটি চালু করল। ট্রেনটি মাটি থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠল। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসী হতবাক। তারা ভাবতেও পারেনি যে রাজুর মতো এক বালক এমন কিছু তৈরি করতে পারে। শিশুরা চিৎকার করে উঠল আনন্দে।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ঠিক তখনই। ট্রেনের শক্তি হঠাৎ কমে যেতে শুরু করল। টিনু বলল, ‘রাজু, সোলার সেলগুলো পর্যাপ্ত শক্তি দিচ্ছে না। আমাদের আরেকটি উপায় বের করতে হবে।’
রাজু ভয় না পেয়ে ভাবতে শুরু করল। তার মনে হলো, বাতাস থেকে কি শক্তি সংগ্রহ করা যায়? টিনু দ্রুত তার প্রোগ্রামিং দিয়ে বাতাসের গতি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা করল। ট্রেনটি আবার সচল হলো। গ্রামবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
উড়ন্ত ট্রেনটি এখন শুধু একটি যন্ত্র নয়; এটি ছিল গ্রামের মানুষের আশা আর অনুপ্রেরণার প্রতীক। রাজু সবাইকে বলল, ‘যদি আমরা পুরোনো জিনিস নতুনভাবে ব্যবহার করতে পারি, তবে কোনো কিছুই ফেলনা নয়। বিজ্ঞান আর মনোযোগ দিয়ে আমরা যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারি।’
গ্রামের শিশুরা রাজুর কাছে এসে তার মতো শেখার আগ্রহ প্রকাশ করল। রাজু তাদের জন্য একটি বিজ্ঞান ক্লাব তৈরি করল, যেখানে সবাই নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করত। উড়ন্ত ট্রেনটি এখন শুধু গ্রামবাসীর নয়, বরং পুরো অঞ্চলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল।
গ্রামের মানুষ আর শিশুদের অনুপ্রাণিত করে রাজু তার গবেষণা চালিয়ে গেল। সে বুঝেছিল, প্রকৃতিকে সম্মান করে, প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কেকে/এএম