আওয়ামী সরকারের অধীনে জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এসব অধিকারগুলোর ওপর নানাভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। পাকিস্তানপন্থি বিদ্যমান সংবিধানকে পতিত আওয়ামী সরকার নিজের মতো পরিমার্জন-পরিবর্ধন করে বছরের পর বছর তাদের বাধাহীন দুর্নীতির পথকে সুগম করেছে।
বিগত সরকারের জনমত বিরোধী কর্মকাণ্ড দেশে গণতন্ত্রের বিকাশকে দারুণভাবে ব্যাহত করে। তারা বরাবরই নির্বাচনে কারচুপি থেকে শুরু করে জনতার বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা, সভা ও মিছিল মিটিংয়ের অধিকার এবং নাগরিকদের গণতান্ত্রিক সব অধিকারগুলো বিভিন্নভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিক সমাজের এসব অপূর্ণ অধিকার ও ন্যায়ভিত্তিক দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বির্নিমানের প্রয়োজনীয়তা থেকে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন।
যেখানে দেশের বিদ্যমান সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে ৬ অক্টোবর অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। ওই কমিটির তিনমাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও নানাবিধ জটিলতার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। সেজন্য চলতি বছরের ২ জানুয়ারি নির্বাহী পরিষদের এক প্রজ্ঞাপনে ১৫ জানুয়ারি কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ধার্য করা হয়।
অবশেষে গত বুধবার সকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৪টি কমিশন—সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের নিজ নিজ কমিশনের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পরে ওই দিনই বিকালে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সংবাদ সম্মেলনে আইন, পরিবেশ ও স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টারা বিষয়টা অবহিত করেন। এ ছাড়া প্রত্যেক কমিশনের প্রধানের পৃথক পৃথক সংবাদ সম্মেলনেও বিষয়টি উঠে আসে। জমা পড়া সুপারিশগুলোর প্রাধান্য ঠিক করতে কমিশনগুলো দ্রুত কাজ করলে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকেই রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হবে বলে জানানো হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশন তার সুপারিশে একটি কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতার লক্ষ্যে জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনাসহ বিধিবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
বিদ্যমান সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশি’ প্রতিস্থাপিত করার সুপারিশ এসেছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ এবং ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনায় পরিবর্তন এনে মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে ‘জনযুদ্ধ’ শব্দের ব্যবহার এবং ২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার আদর্শে রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। নাগরিকতন্ত্রের ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের স্থলে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহার হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে।
ইংরেজির ক্ষেত্রে ‘রিপাবলিক’ এবং ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ বিদ্যমান শব্দগুলোই বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। ভাষার ক্ষেত্রে কমিশন জানিয়েছে নাগরিকতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে ‘বাংলা’। তবে সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত সব ভাষাকে এ দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যুক্ত হওয়া সংবিধানবিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধ কমিশন সংবিধানের অনুচ্ছেদের ৭ক এবং ৭খ বিলুপ্তির অনুরোধ করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন বিদ্যমান আইনসভা পদ্ধতি বাতিল করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে; যেখানে নিম্নকক্ষ (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) এবং উচ্চ কক্ষ (সিনেট) নিয়ে ওই আইনসভা গঠিত হবে।
কমিশনে উভয় কক্ষের মেয়াদ রাখা হয়েছে চার বছর। বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনসভার নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা হবে ৪০০। যেখানে ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকা থেকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। এবং বাকি ১০০ জন নারী সদস্য সারা দেশের সব জেলাকে ১০০টি নির্বাচনি এলাকার মর্মে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন।
কমিশন জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০% আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। সংসদ সদস্য নির্বাচনের বয়স বিদ্যমান ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ বছর করা হবে। সংসদে দুইজন ডিপুটি স্পিকার থাকবেন যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবে। একজন সংসদ সদস্য একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হবে না।
কমিশন এটাও নিশ্চিত করেছে যে অর্থবিল ব্যতিত নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাদের মনোনয়নকারী দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পূর্ণ এখতিয়ার পাবে। এমনকি সব স্থায়ীকমিটির সভাপতি হবে বিরোধীদলীয় সদস্যরা। সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত সংবিধানে আইনসভার উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সুপারিশ পেশ করে।
প্রস্তাবিত সংবিধানে আইনসভার উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে; এর মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদে নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবে। অবশিষ্ট ৫টি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্যে থেকে প্রার্থী মনোনীত করবেন। প্রস্তাবনায় কোনো রাজনৈতিক দলকে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংসদ নির্বাচনে কমপক্ষে ১ শতাংশ ভোট পাওয়া লাগবে।
কমিশনের সুপারিশে এটাও উঠে এসেছে যে সংবিধানের সংশোধনের জন্য উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। আন্তর্জাতিক সব চুক্তির ক্ষেত্রেও কমিশন উভয়কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদন প্রয়োজনের কথা বলেছে। বিদ্যমান সংবিধানের মতো প্রস্তাবিত সংবিধানেও রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ এবং সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের বিধান রাখা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে প্রস্তাবটি নিম্নকক্ষে অনুমোদনের পর উচ্চকক্ষে যাবে এবং শুনানির মাধ্যমে ওই অভিশংসনটি সম্পূর্ণ হবে বলে মনে করা হয়।
তিনটি অঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতসহ ভারসাম্য রক্ষায় একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে অ্যার্টনি জেনারেল, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে এনসিসি রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। কমিশন জানিয়েছে প্রস্তাবিত সংবিধানে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদির বেশি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
যেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলী তথা আইনসভার উভয়কক্ষের সদস্য, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল এবং সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিলের পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রপতির মতো প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদও হবে চার বছর। কোনোক্রমেই কেউ দ্বিতীয়বারের মতো সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশে আইনসভার মেয়াদ শেষ হলে বা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে; যাদের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে এবং অধস্তন আলাতের পরিবর্তে স্থানীয় আদালত ব্যবহারের সুপারিশ জানিয়েছে। কমিশন বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানের সুপারিশ করেছে। প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি কেবল এনসিসির সিদ্ধান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন।
তবে এ অবস্থায় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে এবং তাদের আদালতের দারস্থ হওয়ার পথেও কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারবে না। আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সংবিধানটি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের একটা মাইলফলক হিসেবে গ্রহণ করার মতো।
১৯৭১ এর স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং ২০২৪ গণ-আন্দোলনের জনআকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রস্তাবিত সংবিধানটি দারুণভাবে সফল হতে পারে। তবে কতটুকু কার্যকর হবে এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সংবিধানে রাজনৈতিক দলগুলো সংহতি প্রকাশ করবে নাকি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাই এখন দেশবাসীর কাছে উদ্বেগের বিষয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক
কেকে/এএম