দালালের খপ্পরে পড়ে উন্নত জীবনের আসায় ইতালিতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলো মাদারীপুর সদরের রাকিব মহাজন নামে এক যুবক। দীর্ঘ তিন বছর লিবিয়ার গেমঘরে দালাল চক্রের ভয়াবহ অমানবিক নির্যাতন শিকার হয়ে অবশেষে মারা গেছেন বলে খবর পেয়েছে তার পরিবার। সেই খবরে নিহতের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পাড়া প্রতিবেশীরা।
বুধবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে রাকিব মহাজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার পরিবার। রাকিব মহাজন মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের নাজিম উদ্দিন মহাজনের ছেলে। এদিকে প্রশাসন থেকে আইনগত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
নিহত রাকিবের পরিবারের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তিন বছর আগে উন্নত জীবনের আশায় মাদারীপুর সদর উপজেলার মৃত ফটিক মৃধার ছেলে জাহাঙ্গীর মৃধার প্রলোভনে পড়ে রাকিব মহাজন। জাহাঙ্গীর মৃধা তার ভায়রা শরীয়তপুরের পালং থানার ধানুকা ইউনিয়নের ছোট বিনোদপুর গ্রামের সোহাগ মাতুব্বরের মাধ্যমে ২৭ লাখ টাকায় ইতালিতে পৌছে দেয়ার চুক্তি করে। সে মতে ২৭ লাখ টাকা দিয়ে তিন বছর আগে রাকিব পাড়ি জমান লিবিয়া। তবে লিবিয়ার নেয়ার পরে গেমঘরে রেখে আরো টাকার জন্যে নির্যাতন চালাতে থাকে সোহাগ মাতুব্বর। পরে রাকিবের পিতা নাজিম উদ্দিন মহাজন ধার-দেনা করে আরো ৫ লাখ টাকা দেন সোহাগকে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। লিবিয়ায় দুই বছর চার মাস অসহ্য যন্ত্রণা-নির্যাতন সহ্য করে কাটিয়েছে রাবিক।
আরো জানা যায়, দুই বছর চার মাস পরে সোহাগের গেমঘর থেকে বেরিয়ে আরেক দালাল সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাক্ষ্মন্দী গ্রামের মাজেদ খলিফাকে ধরে রাকিবের পরিবার। তাকেও ৮ মাস আগে ১৫ লাখ টাকা দেয় গেম করার জন্যে। কিন্তু তিনিও টাকা নিয়ে গেমঘরেই নির্যাতন চালায় সোহাগকে। এক পর্যায়ে রাকিব গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়লে লিবিয়ার একটি হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যু হয় রাকিবের। তার মৃত্যুর খবর পরিবারকে দালাল মাজেদ খলিফাই রাকিবের পরিবারকে জানান। দেন প্রাণহীন দেহের কয়েকটি ছবি-ভিডিও। এতে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো পরিবারসহ এলাকাবাসীর মধ্যে।
এব্যাপারে নিহত রাকিবের পিতা নাজিম উদ্দিন মহাজন জানান, ‘দফায় দফায় টাকা দিয়ে আমি সর্বশান্ত হয়ে গেছি। এ পর্যন্ত সোহাগ আর মাজেদকে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছি। তারপরে এখন আমার ছেলের মৃত্যুর খবর শুনতে হলো। আমার ছেলে না খাইয়ে মেরে ফেলছে। কয়েকদিন আগেও আমার ছেলে ভিডিওতে তার নির্যাতনের কথা বলেছে। আর বাচাঁর জন্যে আকুতি করেছে। কিন্ত আমার ছেলেকে বাচাতে পারলাম না।’
এভাবে দালাল চক্রের কারণে উঠতি বয়সী রাকিরের মৃত্যকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না পরিবার ও এলাকাবাসী। তারা দোষীদের বিচার দাবী করেন। সেই সাথে রাকিবের মরদেহ দেশে আনারও দাবী করেন। নিহতের ছোট চাচা শাহজালাল মহাজন বলেন, ‘নির্যাতন করে আমার ভাতিজাকে হত্যা করেছে। এখন দালালরা বলে অসুস্থ্য হয়ে রাকিব মারা গেছে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। এভাবে যেন আর কোন মায়ের বুঁক খালি হতে না হয়।’
তবে অভিযোগের বিষয় স্থানীয় দালাল জাহাঙ্গীর মৃধা বলেন, আমার ভায়রা সোহাগ বিধায় আমাকে জড়ানো হচ্ছে। কেউ বলতে পারবে না যে, আমি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। আর ওই ছেলে অসুস্থ্য হয়ে লিবিয়ায় মারা গেছে। আমার ভায়রা বরং সেখানে ট্রিটমেন্ট করেছে। এর বেশি কিছু জানি না।’
আর মাজেদ খলিফার বাড়ীকে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা বলেছেন, মৃত্যুর বিষয়টি জানার পরে তার পরিবার বাড়ী থেকে পালিয়েছে।
এদিকে মাদারীপুর জেলা পুলিশের তথ্য মতে, মাদারীপুর গেলো বছর লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে জেলার অন্তত শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০শ’ মামলা দায়ের হয়েছে পাঁচ শতাধিক দালালের বিরুদ্ধে। কিন্তু মামলায় জামিন পেয়ে পুনরায় দালালিতে যুক্ত হয় তারা। তাই এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান। তিনি বলেন, বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি মাদারীপুরে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে। আমরা জেলা পুলিশ এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্সে আছি।
একটি সূত্র মতে, মাদারীপুরে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালিতে মানবপাচার করছেন প্রতারক চক্র। এতের মদদ দিচ্ছে রাজনৈতিক একটি মহল। ফলে ধরা-ছোয়ার বাহিরেই রয়ে যাচ্ছে দালাল চক্র।
কেকে/এআর