আমরা বিশিষ্ট ব্যক্তি দ্বারা নানা সময়ে নানাভাবে অনুপ্রাণিত হই। তারা জীবনকে কীভাবে যাপন করছেন, তা জানতে চাই। তারা কী খেতে ভালোবাসে, কী করতে ভালোবাসে, অবসর সময় কীভাবে কাটায়—এসব বিষয়ে আমরা কৌতুহলী। এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রতি বছর নানা ধরনের বই পড়ে থাকে, বইপ্রেমিদের জন্য থাকছে তেমনই কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রিয় বই।
বিল গেটসের প্রিয় পাঁচটি বই
বই মানুষের জীবনের এমন এক নিঃশব্দ সঙ্গী, যা জ্ঞানের পথকে আলোকিত করে এবং কল্পনার ডানাকে বিস্তৃত করে। একজন সফল মানুষকে চেনার অন্যতম উপায় হলো তার পছন্দের বইগুলো সম্পর্কে জানা। বিখ্যাত মাইক্রোসফট সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি শুধু প্রযুক্তির জগতে বিপ্লব ঘটিয়েই থেমে যাননি, বরং নিজের পঠিত বইগুলো নিয়মিত শেয়ার করে জ্ঞান পিপাসুদের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর নির্বাচিত বইগুলো আমাদের কেবল মনের খোরাক জোগায় না, বরং জীবন ও জগতকে নতুনভাবে দেখার অনুপ্রেরণাও দেয়।
মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস প্রতি বছর তাঁর পঠিত প্রিয় বইগুলোর তালিকা প্রকাশ করেন। সম্প্রতি তিনি তার ব্লগ ‘গেটস নোটস’-এ পছন্দের পাঁচটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন, যা আমাদের চারপাশের জগৎকে ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করবে। এই বইগুলো হলো—
১. অ্যান আনফিনিশড লাভ স্টোরি—ডরিস কার্নস গুডউইন।
এই বইটি ডরিসের আত্মজীবনী, যেখানে তার প্রয়াত স্বামীর সঙ্গে জীবনের নানা দিক আলোকপাত করা হয়েছে। ডরিস একজন প্রতিভাবান লেখক, এবং তাঁর প্রেমের গল্পের বিভিন্ন অধ্যায় কেনেডি হত্যাকাণ্ড ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঙ্গে জড়িত।
২. দ্য অ্যাংশাস জেনারেশন— জোনাথন হাইডট।
এই বইয়ে আজকের তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা ও আবেগীয় বিকাশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখক খেলাধুলাভিত্তিক শৈশব থেকে স্মার্টফোননির্ভর শৈশবে স্থানান্তরের ফলে শিশুদের আবেগীয় বিকাশে কীভাবে পরিবর্তন আসছে, তা বিশ্লেষণ করেছেন এবং সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন।
৩. ইঞ্জিনিয়ারিং ইন প্লেইন সাইট—গ্রাডি হিলহাউস।
এই বইয়ে আমাদের চারপাশের বিভিন্ন কাঠামো, যেমন তারের বাক্স, ট্রান্সফরমার, মোবাইল ফোনের টাওয়ার ইত্যাদি কীভাবে কাজ করে, তার সহজ ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। কৌতূহলী পাঠকদের জন্য এটি একটি চমৎকার বই।
৪. দ্য কামিং ওয়েভ—মুস্তাফা সুলেমান।
এই বইয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং জিন সম্পাদনার মতো বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সমাজের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখক ভবিষ্যতের ঝুঁকির জন্য প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
৫. ফেদেরার—ডরিস হেঙ্কেল।
এই বইটি টেনিস কিংবদন্তি রজার ফেদেরারের জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বইটিতে অনেক অদেখা ছবি রয়েছে, যা টেনিস ভক্তদের জন্য দারুণ একটি সংগ্রহ।
বারাক ওবামার প্রিয় ১৫টি বই
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বই পড়ার প্রতি এক নিখাদ ভালোবাসা পোষণ করেন। প্রতি বছর তিনি তার প্রিয় বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেন, যা পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে এবং তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসকে উৎসাহিত করে।
১. দ্য হ্যাভেন অ্যান্ড আর্থ গ্রোসারি স্টোর—জেমস ম্যাকব্রাইড।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছোট শহরের এক গ্রোসারি দোকানকে ঘিরে লেখা এই উপন্যাসে মানুষের সম্পর্ক, আশা এবং জীবনের সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে।
২. দ্য ম্যানিয়াক—বেঞ্জামিন লাবাতুত।
গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং বিজ্ঞানীদের জীবন ঘিরে লেখা এই বইটি বিজ্ঞান ও মানবিকতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে।
৩. পোভার্টি, বাই আমেরিকা—ম্যাথিউ ডেসমন্ড।
এই বইয়ে আমেরিকার দারিদ্র্য সমস্যার কারণ, এর প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধানের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
৫. হাউ টু সে ব্যাবিলন—সাফিয়া সিনক্লেয়ার।
কবি সাফিয়া সিনক্লেয়ারের এই স্মৃতিকথা তাঁর শৈশব, পরিবার এবং নিজের কণ্ঠ খুঁজে পাওয়ার গল্প।
৫. দ্য ওয়েগার—ডেভিড গ্র্যান।
সমুদ্রযাত্রা ও বেঁচে থাকার কাহিনী নিয়ে লেখা এই বইটি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
৬. চিপ ওয়ার—ক্রিস মিলার।
আধুনিক প্রযুক্তি এবং সেমিকন্ডাক্টরের ওপর লেখা এই বই প্রযুক্তি বিশ্ব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
৭. দ্য ভাস্টার ওয়াইল্ডস—লরেন গ্রফ।
একটি তরুণ মেয়ের বেঁচে থাকার কাহিনী, যেখানে প্রকৃতি ও মানবিকতা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করে।
৮. হিউম্যানলি পসিবল—সারাহ বেকওয়েল।
এই বইতে মানবিক দর্শনের ইতিহাস এবং এর বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে।
৯. কিং: অ্যা লাইফ—জোনাথন ইগ।
কিংবদন্তি নাগরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জীবনকাহিনী নিয়ে লেখা এই বই তাঁর সংগ্রাম ও আদর্শকে উদ্ভাসিত করে।
১০. দ্য কভন্যান্ট অব ওয়াটার—আব্রাহাম ভার্গিস।
একটি ভারতীয় পরিবারের প্রজন্মের গল্প, যেখানে জল প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
১১. দ্য বেস্ট মাইন্ডস—জোনাথন রোজেন।
মানসিক অসুস্থতা এবং বন্ধুত্বের গভীর দিক নিয়ে লেখা এই বই হৃদয়স্পর্শী।
১২. অল দ্য সিনারস ব্লিড—এস. এ. কসবি।
একটি রহস্য উপন্যাস, যেখানে বর্ণবাদ, ন্যায়বিচার এবং মানবতার বিভিন্ন দিক চিত্রিত হয়েছে।
১৩. দ্য কিংডম, দ্য পাওয়ার, অ্যান্ড দ্য গ্লোরি—টিম আলবার্টা।
আমেরিকার রাজনীতি এবং মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণামূলক বই।
১৪. সাম পিপল নিড কিলিং—প্যাট্রিসিয়া ইভাঞ্জেলিস্টা।
ফিলিপাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনীতির অন্ধকার দিক নিয়ে লেখা একটি প্রতিবেদনমূলক বই।
১৫. দিস আদার ইডেন—পল হার্ডিং।
ইতিহাস, মানবতা এবং পরিবেশের সংযোগ নিয়ে লেখা একটি চমৎকার উপন্যাস।
যদি আপনি জ্ঞান ও অনুপ্রেরণার জন্য নতুন বইয়ের সন্ধান করেন, ওবামার এই তালিকা নিঃসন্দেহে আপনার জন্য সেরা একটি দিকনির্দেশনা হতে পারে।
ইলন মাস্কের প্রিয় পাঁচটি বই
ইলন মাস্ক—স্পেসএক্স, টেসলা, নিউরালিংক, এবং দ্য বোরিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা—জীবন এবং জ্ঞানের প্রতি তার অগাধ আগ্রহের জন্য পরিচিত। একজন উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবক হিসেবে তিনি প্রযুক্তি ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন এবং সেই চিন্তাধারা গঠনে বই তার প্রধান অনুপ্রেরণা। ইলন তার শৈশব থেকেই প্রচুর বই পড়ে এসেছেন।
১. দ্য হিচহাইকারস গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি—ডগলাস অ্যাডামস।
এটি মাস্কের প্রিয় সায়েন্স-ফিকশন বইগুলোর একটি। বইটি হাস্যরস এবং গভীর দার্শনিক প্রশ্নের মাধ্যমে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
২. স্ট্রাকচারস: অর হাই থিংস ডোন্ট ফল ডাউন—জে. ই. গর্ডন।
প্রকৌশল এবং পদার্থবিদ্যার গভীর বিষয়গুলো সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা এই বইটি ইলনের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।
৩. লর্ড অফ দ্য রিংস—জে. আর. আর. টলকিন।
এই কাল্পনিক উপন্যাসটি ইলনকে নেতৃত্ব এবং লক্ষ্যপূরণের গুরুত্ব সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করেছে।
৪. সুপারইন্টেলিজেন্স—নিক বোস্ট্রোম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ এবং তার ঝুঁকি সম্পর্কে লেখা এই বইটি ইলনের এআই-ভিত্তিক কাজ এবং সতর্কতার ধারণাকে শক্তিশালী করেছে।
৫. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন: অ্যান আমেরিকান লাইফ—ওয়াল্টার আইজাকসন।
এই জীবনী ইলনকে উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবক হিসেবে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে অনুপ্রাণিত করেছে।
মার্ক জাকারবার্গের প্রিয় পাঁচটি বই
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, মার্ক জাকারবার্গ, প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করে চলেছেন। তবে তার সফলতার পেছনে যে প্রেরণা এবং চিন্তার গভীরতা রয়েছে, তা তিনি তার পছন্দের বইগুলো থেকে লাভ করেছেন। প্রতি বছর, জাকারবার্গ তার পছন্দের বইগুলো শেয়ার করেন, যা আমাদের চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে সহায়ক হতে পারে।
১. অ্যানিমেল ফার্ম—জর্জ অরওয়েল।
এটি একটি ক্লাসিক উপন্যাস। এই উপন্যাসটিতে সমাজের অন্ধকার দিক এবং শক্তি ব্যবস্থার অপব্যবহারের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে।
২. দ্য হিরোস জার্নি—জোসেফ ক্যাম্পবেল।
এই বইটি মানুষের গল্প ও অভিজ্ঞতাগুলোর বিশ্লেষণ করে।
৩. ফাউন্ডেশন—আইজ্যাক আসিমভ।
এই বইটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর একটি মাইলফলক এবং সমাজের অগ্রগতির সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রদান করে।
৪. হাউ টু থিঙ্ক লাইক এ ফিশ—ল্যারি স্মিথ।
এই বইটি আমাদের চিন্তার পদ্ধতির পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে খোলামেলা চিন্তা করার গুরুত্ব তুলে ধরে।
৫. জেরুসালেম—সিমন সেবাগ।
এই বইটি জেরুসালেম শহরের ইতিহাস এবং এর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে।
মার্ক জাকারবার্গের পছন্দের বইগুলো থেকে আমরা শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বাইরেও জীবনের নানা দিক এবং মানুষের অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারি।
ওয়ারেন বাফেটের প্রিয় পাঁচটি বই
একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে, ওয়ারেন বাফেট শুধুমাত্র বিনিয়োগে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেননি, বরং তিনি বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞানের অজস্র দিক উপলব্ধি করেছেন। বই তার চিন্তাভাবনা এবং বিনিয়োগ কৌশলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, এবং তিনি বেশ কয়েকটি বইকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ওয়ারেন বাফেট প্রতি বছর তার পছন্দের বই সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং সেগুলো ভাগ করে নেন তার অনুসারীদের সাথে।
১. দ্য ইনভেস্টমেন্ট গাইড—বেঞ্জামিন গ্রাহাম।
এটি ওয়ারেন বাফেটের সবচেয়ে প্রিয় বই। গ্রাহাম এই বইয়ে মূল্যবোধন পদ্ধতি এবং দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
২. দ্য রিচেস্ট ম্যান ইন বেবিলন—জর্জ এস. ক্লাসন।
এই বইতে পার্থিব জীবনের বুনিয়াদ হিসেবে অর্থ উপার্জন, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
৩. ফ্লড অ্যান্ড রিজন—চার্লস পি. কিগলি।
এই বইতে মানব মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক এবং আর্থিক বাজারের মিথ্যাচারিতার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
৪. দ্য ডেকারমিনেন্ট অব ওয়াল স্ট্রিট—জে. লেভিন।
এই বইয়ে পুঁজি বাজারের ইতিহাস এবং তার কর্মপদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে।
৫. ওয়াল স্ট্রিট স্নেক—মাইকেল লুইস।
এই বইতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সংকট ও শেয়ার বাজারের চালচলনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ওয়ারেন বাফেটের পছন্দের বইগুলো তার আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিনিয়োগ কৌশলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি বইগুলো পড়ে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের মূলনীতি এবং বাজারের আচরণ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান পাঠ নিয়েছেন। এসব বই তাকে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করেছে এবং আজকের সাফল্য লাভ করতে সহায়ক হয়েছে।
কেকে/এএম